৩৪ বছরে প্রতিশ্রুতি বহু, টেকসই বেড়িবাঁধ পেল না কুতুবদিয়া
কক্সবাজারের উপকূলীয় দ্বীপ কুতুবদিয়ায় একের পর এক জলোচ্ছ্বাসে ভাঙছে বেড়িবাঁধ, ডুবে যাচ্ছে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। সর্বশেষ জুলাই–আগস্টে আলী আকবর ডেইল, কৈয়ারবিলসহ কয়েকটি ইউনিয়নে অন্তত এক কিলোমিটার বাঁধ বিলীন হয়েছে, ঝুঁকিতে আরও ছয়–সাত কিলোমিটার। পাকিস্তান আমলে নির্মিত ৪০ কিলোমিটার বাঁধের অধিকাংশই এ মুহূর্তে বয়স ও উচ্চ জোয়ারের কাছে নাজুক। ১৯৯১-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর ৩৪ বছর কেটে গেলেও দেড় লাখ লোকের দ্বীপে টেকসই সুপার ডাইক তৈরি হয়নি। ফলে প্রতিবার দুর্যোগেই বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন হাজারো মানুষ; এখন পর্যন্ত বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জিও টিউব ফেলে আপৎকালীন মেরামত করছে এবং সেপ্টেম্বরে সাড়ে ছয় কিলোমিটার ‘সুপার ডাইক’ শুরু করার আশা জানালেও ৮০ হাজার কোটি টাকার উপকূল সুরক্ষা প্রকল্পে অর্থায়ন মিলছে না।
প্রেক্ষাপট
বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমে অবস্থিত ৩০ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে ঘূর্ণিঝড় ও উচ্চ জোয়া্র ছাপ এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। ১৯৯১-এর ঝড়ে শুধু আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের দুটি মৌজা মানচিত্র থেকে মুছে যায়, মারা যায় ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। তখন থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার মূল বেড়িবাঁধ একবারের জন্যও পুরোপুরি পুনর্গঠন করা যায়নি। পাউবো বলছে, জুলাই মাসেই সাগরে পাঁচটি লঘুচাপ তৈরি হওয়ায় বাঁধের ক্ষতি বেড়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• দ্বীপের আয়তন: ৩০ বর্গকিমি (আগে ১০০)
• বর্তমান জনসংখ্যা: ১.৫৩ লাখ
• বেড়িবাঁধ: মোট ৪০ কিমি, ঝুঁকিতে ৭ কিমি
• বিলীন হওয়া বসতভিটা: সাম্প্রতিক জোয়ারে ৩০+, তিন দশকে ৬০ হাজার মানুষ দ্বীপ ছেড়েছে
• সম্ভাব্য ‘সুপার ডাইক’ প্রকল্প ব্যয়: ৮০,১৩২ কোটি টাকা (৬৪২ কিমি উপকূল), এর মধ্যে কুতুবদিয়া অংশ ৬৩ কিমি
প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তফা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘর তিনবার সরিয়েছি, এখন আর জায়গা নেই।’ ইউপি সদস্য মীর কাশেম জানালেন, কৈয়ারবিলের ৪৫০টি পরিবার ভাঙা বাঁধের পাশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে, আশ্রয়কেন্দ্রও নেই। কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী আশঙ্কা করেন, “টেকসই বাঁধ না হলে দ্বীপের অবশিষ্ট অংশও হারিয়ে যাবে।”
বৃহত্তর চিত্র
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, একই সঙ্গে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের ঘনত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে—জাতিসংঘের আইপিসিসি রিপোর্টেও এ কথা বলা হয়েছে। কুতুবদিয়া এ বাস্তবতার একটি পরীক্ষাগার। দ্বীপের লবণ ও মৎস্যখাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও অবকাঠামো দুর্বলতার কারণে বিনিয়োগ কমছে, কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হচ্ছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুর চাপ পড়ছে আশপাশের জেলা শহর ও পাহাড়ি এলাকায়।
পরবর্তী পদক্ষেপ
পাউবো উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জামাল মুর্শিদ রয়টার্সকে জানান, ‘সাগর শান্ত হলেই সেপ্টেম্বরে সাড়ে ছয় কিলোমিটার সুপার ডাইক শুরু করব।’ তবে নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম স্বীকার করেন, পুরো ৪০ কিলোমিটার বাঁধের জন্য সরকার যে ডিপিপি করেছে, তা এখনো অর্থ মন্ত্রণালয় ও উন্নয়ন-অংশীদারদের কাছ থেকে অর্থ পায়নি। তাই দ্রুত অনুমোদন ও অর্থায়ন জরুরি বলে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন।
বিশ্লেষণ
কুতুবদিয়ার সমস্যা শুধু টাকার নয়, সমন্বয়হীনতা ও নকশাতেও। পাকিস্তান আমলের ১০-১২ ফুট উঁচু বাঁধ আজকের জলোচ্ছ্বাস সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছে; নতুন নকশাকে অন্তত ১০ মিটার উচ্চতা ও কংক্রিট ব্লক সুবিধাযুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি বাঁধের ওপর দুই লেনের সড়ক পরিকল্পিত হলে পর্যটন ও পণ্য পরিবহণে দ্বীপের নতুন সম্ভাবনা খুলবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে ‘নেচার–ভিত্তিক সমাধান’—ম্যাংরোভ বেষ্টনী, কৃত্রিম টিলাসহ—প্রস্তাব দিয়েছে, যা মূল বাঁধকে সহায়তা করতে পারে।
শেষ কথা
জলবায়ু সঙ্কটে বাংলাদেশের প্রথম সারির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি কুতুবদিয়া। এখানে টেকসই বেড়িবাঁধ না এলে সরকারকে পুনর্বাসন, খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের আরও বড় খরচ বহন করতে হবে। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই সুপার ডাইক প্রকল্পে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হলে ‘সাগরের গিলে ফেলা দ্বীপ’ শিরোনামটা হয়তো শিগগিরই বাস্তবতা হয়ে উঠবে।

