ফেনী সীমান্তে বাংলাদেশি আটক, বিজিবি–বিএসএফ টক্কর আর আলোচনার মধ্যে নতুন উত্তেজনা
সোমবার সকাল ৯টার দিকে ফেনীর পরশুরাম উপজেলার উত্তর কেতরাঙ্গা সীমান্তের ২১৭৪ নম্বর পিলার এলাকা থেকে নুরুল ইসলাম (৬৩)-কে ধরে নিয়ে গেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। ঘটনাটি নিশ্চয়তা দেন ৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মশারফ হোসেন, যিনি জানান—বিকেলের মধ্যে বিএসএফ আটক ব্যক্তিকে ফেরত দেওয়ার কথা দিয়েছে। ঠিক এমন সময়, ২৫–২৮ আগস্ট ঢাকার পিলখানায় ৫৬তম মহাপরিচালক-স্তরের সীমান্ত সম্মেলন বসতে যাচ্ছে, যেখানে অনুপ্রবেশ, সীমান্ত হত্যা ও চোরাচালান রোধসহ অভিন্ন ইস্যুতে আলোচনায় বসবে দুই বাহিনী।
পটভূমি
বাংলাদেশ-ভারত ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থলসীমান্তে গড়পড়তা প্রতিদিনই গবাদি পশু, মাদক ও মানুষের অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে ছোট বড় ঘটনার খবর আসে। বিজিবি সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে সীমান্তে গুলিতে ১,২০০–এর বেশি বাংলাদেশি নিহত বা আহত হয়েছেন। ফেনীর কেতরাঙ্গা এলাকাটি তুলনামূলক শান্ত মনে হলেও চলতি বছরে সেখানে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশি আটক হলেন।
প্রতিক্রিয়া
৪ বিজিবির অধিনায়ক মশারফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, "বিএসএফ আমাদের জানিয়েছে, লোকটি নাকি ভুল করে কাঁটাতার পার হয়েছিলেন। তারা বিকেলের মধ্যে ফিরিয়ে দেবে।" গ্রামবাসী অভিযোগ করছেন, সীমান্তে কাঁটাতার থাকলেও কৃষিকাজ, মৌসুমি হলুদ সংগ্রহ কিংবা গবাদি পশু হারানো খুঁজতে গিয়ে তাঁরা প্রায়ই অনিচ্ছায় জিরো লাইনে চলে যান—যা বিএসএফ কখনও "অনুপ্রবেশ" হিসেবে ধরে নেয়। বিএসএফের আনুষ্ঠানিক মন্তব্য এখনো আসেনি, তবে দিল্লিস্থ বাহিনীর এক কর্মকর্তা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, "মানবিক বিবেচনায় দ্রুত রিহ্যান্ডওভার করা হবে।"
প্রেক্ষাপট
এই আটক-ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, আগামী ২৫–২৮ আগস্ট পিলখানায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক হবে। বিজিবির বিজ্ঞপ্তি বলছে, এজেন্ডার শীর্ষে আছে—সীমান্ত হত্যা, অনুপ্রবেশ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, ১৫০ গজের মধ্যে অবকাঠামো, নদীর তীর সংরক্ষণ ও প্রচার-যুদ্ধ বন্ধ। শেষবার ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে বসেছিল এমন বৈঠক, সেখানেও "জিরো টলারেন্স" নীতি গ্রহণের ঘোষণা আসে, কিন্তু মাঠে তার প্রতিফলন মিলছিল না।
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• ৪,০৯৬ কিমি: বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য
• ১,২০০+: বিগত ১২ বছরে সীমান্তে নিহত-আহত বাংলাদেশি (বিজিবি সূত্র)
• ২৫–২৮ আগস্ট: আসন্ন মহাপরিচালক-পর্যায়ের সীমান্ত বৈঠকের তারিখ
• ৬৩ বছর: আটক নুরুল ইসলামের বয়স
বিশ্লেষণ
ফেনীর ঘটনাটি একদিনের মধ্যেই মীমাংসা হলে হয়তো বড়সড় কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে গড়াবে না, কিন্তু এটি দুই বাহিনীর মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি আর "সীমান্তনির্ভর জীবনযাত্রা"র বাস্তবতা সামনে আনছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) মোহাম্মদ আলী মনে করেন, "কাঁটাতারের দুই পাশে গ্রামীণ বসতি এত ঘন যে, জিরো লাইন মানা সবসময় সম্ভব হয় না। যতোদিন না উভয় পক্ষ এলাকাবাসীর বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করে, এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।" ঢাকায় স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক ড. তানভীর আহমেদ বলছেন, "আসন্ন ডিজি-সম্মেলন যদি দ্রুত রিহ্যান্ডওভার, পতাকা বৈঠক ও যৌথ টহলের কার্যকর টাইমলাইন দিত, তাহলে মাঠ-পর্যায়ে পরিবর্তন আশা করা যেত।"
এরপর কী
বিজিবি বিকেল নাগাদ আনুষ্ঠানিক পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে নুরুল ইসলামকে ফেরত আনার প্রস্তুতি নিয়েছে। ঘটনাটি সফলভাবে নিষ্পত্তি হলে সেটি ২৫ আগস্টের বৈঠকে ইতিবাচক বার্তা হিসেবে কাজে লাগতে পারে। তবে স্থানীয়রা দাবি জানিয়েছেন, কেতরাঙ্গাসহ ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলিতে সোলার লাইট, সিসি ক্যামেরা ও যৌথ আউটপোস্ট স্থাপন করতে। সীমান্ত সম্মেলনে এসব প্রস্তাব উঠলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বদলাতে পারে—নচেৎ সীমান্তবাসীর অনিশ্চয়তা যেমন ও তেমনই রয়ে যাবে।

