টানা বর্ষণে ডুমুরিয়া ডুবে, মহাসড়কেও দুর্ভোগ: দক্ষিণ-পশ্চিমে জলাবদ্ধতার থাবা
টানা মৌসুমি বৃষ্টিতে খুলনার ডুমুরিয়া ও মাদারীপুরের ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। শনিবার (১০ আগস্ট) পর্যন্ত পরপর পাঁচ দিন ভারিবৃষ্টি হওয়ায় ডুমুরিয়ার গ্রামের বাড়ি, স্কুল-কলেজ, মাছের ঘের ও আউশ-ধানের খেত হাঁটু-সমান পানিতে। নৌকা বা বাঁশের সাঁকোই এখন একমাত্র ভরসা; ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মজীবী মানুষেরা ভেজা শরীরেই গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন। একই পানি জমে থাকা মহাসড়কের মাদারীপুর অংশে ৪৭ কিলোমিটার জুড়ে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত; প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার যানবাহন ধীরগতিতে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। স্থানীয় বাসিন্দা, চালক ও কৃষকেরা অবিলম্বে সড়ক সংস্কার ও দ্রুত পানি নিষ্কাশনের দাবি জানিয়েছেন, নইলে দুর্ঘটনা ও ফসল-ক্ষতির আশঙ্কা আরও বাড়বে বলে সতর্ক করেছেন।
পটভূমি
প্রথম আলো রিপোর্ট জানায়, খুলনার ডুমুরিয়ায় গত সপ্তাহ জুড়েই ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৮০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। নিচু এলাকা হওয়ায় নদী ও খালে পানি ঠেলে না যেতে পারায় বাড়িঘর, উঠোন, এমনকি টিউবওয়েল পর্যন্ত ডুবে আছে। বাড়িতে বয়স্ক ও শিশুদের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে; গৃহপালিত পশুপাখি খাবারের খোঁজে ভাসমান আবর্জনার উপর ঘোরাফেরা করছে। এদিকে পদ্মা সেতু চালুর পর যানবাহনের চাপ বহুগুণ বেড়ে যাওয়া ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মাদারীপুর অংশে পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ড্রেনেজ না থাকায় ছোট বৃষ্টিতেই গর্ত তৈরি হয়; দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টিতে গর্তের আকার আরও বড় হয়, তৈরি হয়েছে ‘মরণ ফাঁদ’।
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• ডুমুরিয়ায় টানা বৃষ্টি: ৫ দিন
• প্লাবিত ঘের ও ধানক্ষেত: আনুমানিক ২,৫০০ হেক্টর (উপজেলা কৃষি দপ্তর)
• জলমগ্ন মহাসড়ক: ভাঙ্গা থেকে কালকিনি পর্যন্ত ৪৭ কিমি
• প্রতিদিনের যানবাহন: ২০,০০০টির বেশি (সওজ, মাদারীপুর)
• অস্থায়ী মেরামতের ব্যয়: ৩ কোটি টাকা, টেকসই সংস্কার প্রস্তাব: ৯৮ কোটি টাকা (সওজ প্রাথমিক প্রাক্কলন)
প্রতিক্রিয়া
ডুমুরিয়ার কৃষক মিজানুর রহমান বললেন, "এক সপ্তাহ ধরে জমিতে যেতে পারিনি। পানির নিচে ধান নষ্ট হচ্ছে, মাছের ঘের ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছে।" স্থানীয় স্কুলছাত্রী আয়েশা বলে, "সাঁকো ধরে ভারি ব্যাগ নিয়ে যেতে হয়, পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তা।" মাদারীপুরে বাসযাত্রী নাজমুলের অভিযোগ, "মাথা রাখার জায়গা নেই, একটু পরপর ধাক্কা।" সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হাসান নয়া দিগন্তকে জানান, "নিজস্ব অর্থে ইট-বালু দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ত ভরাট করছি; মন্ত্রণালয়ে টেকসই সংস্কারের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।" স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দ্রুত পাম্প বসিয়ে পানি সরে যাওয়ার উদ্যোগের আশ্বাস দিলেও মাঠ পর্যায়ে এখনও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
শহর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান মনে করেন, "এ ধরনের দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা শুধু বৃষ্টি নয়, অপরিকল্পিত সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার ফল। রাস্তার পাশে খাল ভরাট, অপর্যাপ্ত কালভার্ট ও নিয়মিত খনন না হওয়ায় পানি সরে যায় না।" খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানী ড. রাশেদা বেগম বলেন, "এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনেরও সতর্ক সংকেত। টিকে থাকতে হলে গ্রামের ক্ষেত থেকে মহাসড়ক—সবখানে টেকসই নিষ্কাশন ও উঁচু বাঁধের সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।"
এরপর কী
আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মাঝারি বৃষ্টির সম্ভাবনা বজায় থাকবে। সওজ দাবি করেছে, বরাদ্দ অনুমোদন পেলেই সেপ্টেম্বরের মধ্যে অস্থায়ী কার্পেটিং শেষ করা হবে, তবে ছয় লেনে উন্নয়নের বৃহৎ প্রকল্প অনুমোদন পেলে স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতি তালিকা করছে; ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য পুনর্বাসন প্যাকেজ প্রস্তাব পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন জরুরি পানিবাহী গাড়ি ও মোবাইল স্বাস্থ্যশিবির চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বহু গুণ বাড়বে।

