গাজায় আল জাজিরার পাঁচ সাংবাদিককে নিহত করার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ
রবিবার (১০ আগস্ট) সন্ধ্যায় গাজার আল-শিফা হাসপাতালের মূল ফটকে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় আল জাজিরার প্রতিবেদক আনাস আল-শরীফসহ পাঁচ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। আল জাজিরা ও ঢাকাটাইমসের খবর অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ক্যামেরাপার্সন ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ কুরেইকেহ, মোহাম্মদ নুফাল ও মোয়ামেন আলিয়া। তাবুতে অবস্থানরত সাংবাদিকরা পূর্ব ও দক্ষিণ গাজায় চলমান তথাকথিত “ফায়ার বেল্ট” অভিযানের ভিডিও করছিলেন। ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র দাবি করেছে, আল-শরীফ হামাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; তবে ইউরো-মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটর এ দাবিকে ভিত্তিহীন বলেছে। আল জাজিরা একে “সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে সরাসরি আঘাত” আখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। ঘটনাটি এমন এক সময় ঘটল যখন ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় চলা লড়াইয়ে ২০০-র বেশি সাংবাদিক already প্রাণ হারিয়েছেন।
প্রেক্ষাপট
ইসরায়েল ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রবেশ সীমিত করে রেখেছে। মাঠপর্যায়ে চিত্র ধারণ ও তথ্য যাচাইয়ের প্রধান ভরসা স্থানীয় সাংবাদিকেরা। এই সময়ে আল জাজিরা, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, রয়টার্স ও স্থানীয় সংবাদ সংস্থার বহু কর্মী লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। রোববারের হামলার ঠিক আগেই আনাস আল-শরীফ ‘এক্স’ প্ল্যাটফর্মে গাজার আকাশ কমলা আলোয় ভরে উঠার ভিডিও দেন, যেখানে টানা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এরপর কয়েক মিনিটের মধ্যে হাসপাতাল গেটের কাছে তাঁদের তাবুতে মিসাইল আঘাত হানে। কর্তৃপক্ষ দ্রুত আহতদের শিফা হাসপাতালে নিলেও বাঁচানো যায়নি সাতজনের কাউকেই।
প্রতিক্রিয়া
আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক এক বিবৃতিতে বলেছে, “গাজার সাহসী কণ্ঠগুলোকে চুপ করাতেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছে।” নেটওয়ার্কটি জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অফ জার্নালিস্টস ও হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে দ্রুত তদন্ত চেয়েছে। ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপি জানায়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হামলাকে “সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ” হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিপরীতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে যে আনাস আল-শরীফ হামাসের এক ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন।” তবে প্রমাণের বিষয়ে সাংবাদিকদের সামনে কোনো দলিল হাজির করা হয়নি।
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• ১০ আগস্টের হামলায় নিহত: ৭ জন; এর মধ্যে সাংবাদিক: ৫ জন।
• যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নিহত গণমাধ্যমকর্মী: ২০০-এর বেশি (অ্যাডভোকেসি গ্রুপ CPJ)।
• আল জাজিরা পরিবারের ভুক্তভোগী: অন্তত ৭ সাংবাদিক ও তাঁদের স্বজন।
• গাজা যুদ্ধকালীন সর্বশেষ নিহত শিশুর সংখ্যা: ১৫ হাজারের বেশি (গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি)।
বিশ্লেষণ
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের মতে, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সাংবাদিকদের বহনযোগ্য লাইভ-স্ট্রিম ও ড্রোন ফুটেজ যুদ্ধের প্রবাহ বদলে দিতে পারে বলে সামরিক বাহিনীগুলো ক্রমেই ‘তথ্য-যুদ্ধকেও’ গোলাবারুদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে রিপোর্টাররা সরাসরি নিশানা হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে সাংবাদিকরা বেসামরিক সুরক্ষার আওতায় পড়েন; ইচ্ছাকৃত হত্যা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বিচারের নজির বিরল। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় ইতালিয়ান ফটোগ্রাফার সিমোন কামিলিকে নিহতের ঘটনায়ও কোনও বিচার হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি’ ভাঙা না গেলে মাঠপর্যায়ে স্বাধীন তথ্যপ্রবাহ আরও সংকুচিত হবে।
এরপর কী
কাতারভিত্তিক আল জাজিরা আইসিসিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতিমধ্যে কাতার, তুরস্ক ও আয়ারল্যান্ড কূটনৈতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে ব্যাখ্যা দিতে তাগাদা দিয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামাস-সংশ্লিষ্ট যে কারও বিরুদ্ধে তারা “কঠোর প্রয়োজনীয় শক্তি” ব্যবহার অব্যাহত রাখবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রেস ফ্রিডমবিষয়ক একটি জরুরি অধিবেশন আহ্বানের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ সদস্যদের ঘুরে বেড়াচ্ছে সংস্থাটি। বিশ্লেষকদের ধারণা, নতুন কোনো প্রভাবশালী প্রস্তাব পাস হলেও মিত্রদের ভেটো-রাজনীতির জটিলতায় তা কার্যকর করা কঠিন হবে। তবু পর্যবেক্ষকদের মত, প্রচারমাধ্যমের নিরাপত্তা ঘিরে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ ভবিষ্যৎ সামরিক অভিযানের নিয়মনীতি পুনর্বিবেচনা করতে ইসরায়েলকে কিছুটা হলেও বাধ্য করতে পারে।

