হার্টের ঝুঁকি কি আসলে ডিম, নাকি চিনি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা
হার্টের যত কথা উঠলেই সবার আগে কাঠগড়ায় ওঠে ডিমের কুসুম। ‘চোলেস্টেরল বাড়ায়’—এই যুক্তিতে অনেকেই প্রতিদিনের নاشتায় ডিম ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু ফরাসি বায়োকেমিস্ট ও ‘Glucose Revolution’-এর লেখক জেসি ইনশোস্পে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি দিনে তিন-চারটি ডিম খাই, তবু হৃদ্রোগের ভয় করি না।” তার দাবি, হৃদ্রোগের মূল অপরাধী হল রক্তে অতিরিক্ত চিনি ও গ্লুকোজের বিশৃঙ্খলা, যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও প্রদাহ বাড়িয়ে ক্ষুদ্র, ঘন LDL কণিকা তৈরি করে। একই সময়ে বাংলাদেশি কার্ডিয়োলজিস্টরা প্রতীকী উদাহরণ টেনে মনে করিয়ে দিচ্ছেন—শুধু ইসিজি ‘নরমাল’ এলেও নীরব হার্ট অ্যাটাক ধরা না-ও পড়তে পারে, তাই উপসর্গ অবহেলা নয়। ১৭ জুলাই প্রকাশিত নানা গবেষণা ও চিকিৎসক-পরামর্শ ঘিরে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে: হৃদ্যন্ত্র রক্ষায় আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতি কি বদলানো দরকার?
প্রেক্ষাপট
পঞ্চাশের দশক থেকে ডিমে থাকা ১৮০-২০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরলকে হৃদ্রোগের ‘অসীম শত্রু’ ভাবা হয়েছে। ফলে অনেকেই সপ্তাহে দু-একটি ডিমে সীমাবদ্ধ থাকেন। কিন্তু নিউট্রিশন জার্নালে ধারাবাহিক গবেষণা দেখায়, খাদ্য-কোলেস্টেরলের সঙ্গে রক্তের কোলেস্টেরলের সরাসরি সম্পর্ক খুবই সীমিত। উল্টো, চিনি ও প্রসেস করা কার্বোহাইড্রেটে বাড়তি ক্যালরি এলেই লিভার অতিরিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইড ও ক্ষুদ্র LDL ছাড়ে, যেগুলো ধমনিতে দ্রুত প্ল্যাক জমায়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
জেসি ইনশোস্পে (সূত্র: Daily Janakantha) বলেন, ‘ডিম অসাধারণ পুষ্টিকর—৬ গ্রাম প্রোটিন, ভিটামিন A, D, B12 আর কোলিন থাকে একেকটিতে। এগুলো হার্টের ক্ষতি নয়, বরং সেলের মেরামতে সাহায্য করে।’ ঢাকার হার্ট ফাউন্ডেশনের কার্ডিয়োলজিস্ট ডা. ফারহানা নূর রূটার্সকে জানান, ‘রোগীর ইসিজি ঠিক থাকলেও যদি বুক ধড়ফড়, বাম হাতে ব্যথা বা হঠাৎ ঘাম দেখা যায়, দ্রুত ট্রোপোনিন টেস্ট ও প্রয়োজনে করোনা্রি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা উচিত।’ মালয়েশিয়ার ফাংশনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শার্লি কেহ (সূত্র: Daily Janakantha) যোগ করেন, ‘উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কেবল লবণ কমালেই হবে না, প্রতিদিন কলা, ডালিম, মিষ্টি আলু খাবেন—যাতে পটাশিয়াম বাড়ে এবং সোডিয়াম শরীর ছাড়ে।’
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• প্রতি বড় ডিমে: প্রোটিন ৬ g, কোলিন 147 mg, ভিটামিন D 41 IU, ক্যালরি 70।
• হৃদ্রোগ ঝুঁকিতে LDL লক্ষ্যমান: ৫০ mg/dL (পারিবারিক হিস্ট্রি থাকলে ৩০ mg/dL)।
• উচ্চ রক্তচাপ কমাতে WHO সুপারিশ: দিনে সোডিয়াম ≤ 2,000 mg, পটাশিয়াম ≥ 3,510 mg।
• নীরব হার্ট অ্যাটাক শনাক্তে পর্যবেক্ষণকাল: উপসর্গ শুরু থেকে ১২-২৪ ঘণ্টা অবধি ধারাবাহিক ইসিজি ও দুই দফা ট্রোপোনিন টেস্ট।
এরপর কী
পুষ্টিবিদেরা বলছেন, হোল ফুডস-ভিত্তিক ডায়েট ও রিফাইন্ড সুগার কমালে অধিকাংশেরই কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় আসে। সাপ্তাহিক বাজারের তালিকায় তাই শাক-সবজি, সামুদ্রিক মাছ, অলিভ অয়েল ও স্বাভাবিক ডিম রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। অন্যদিকে চিকিৎসকেরা জোর দিচ্ছেন ‘টেস্টে সব ঠিক’ দেখে ঘরে ফেরার চেয়ে সন্দেহজনক উপসর্গে দ্রুত জরুরি বিভাগে যাওয়ার ওপর। সামগ্রিক বার্তা একটাই—হৃদ্যন্ত্রের জন্য ভয়ের জায়গা ডিমে নয়, বরং অতিরিক্ত চিনি, উচ্চ রক্তচাপ ও দেরিতে ধরা পড়া অ্যাটাকে। পরিকল্পিত খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা আর দ্রুত চিকিৎসা-সেবা মিলেই হতে পারে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘হার্ট ইন্স্যুরেন্স’।