ঢাবিতে দীর্ঘ দুই দশক পর শিবিরের প্রকাশ্য মিছিল, ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ

ঢাবিতে দীর্ঘ দুই দশক পর শিবিরের প্রকাশ্য মিছিল, ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ

বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে জড়ো হয়ে প্রথমবারের মতো নিজেদের ব্যানারে মিছিল করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা। গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মকাণ্ডে হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত এ কর্মসূচি ভিসি চত্বর ঘুরে টিএসসি Rajু ভাস্কর্যে সমাবেশে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো’, ‘লীগ ধর, জেলে ভর’–সহ একাধিক স্লোগান শোনা যায়। ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে শিবির কার্যত ঢাবি ক্যাম্পাস থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর এটি তাদের প্রথম প্রকাশ্য মিছিল, যা প্রশাসন ও অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের কড়া নজর কেড়ে নিয়েছে।

প্রেক্ষাপট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০–এর দশকের শেষভাগ থেকে ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ইতিবাচক শিক্ষাব্যবস্থার বদলে সহিংস রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ২০০০ সালের পর নিয়মিত অভিযান ও বিচারিক নিষেধাজ্ঞার ফলে শিবিরের সাংগঠনিক তৎপরতা ক্যাম্পাসে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ১৬ জুলাইয়ের প্রকাশ্য মিছিলটি শুধু একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি নয়; এটি শিবিরের ‘ক্যাম্পাসে পুনঃপ্রবেশ’-এরও আভাস দিচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

ঘটনাপ্রবাহ

Bangla Tribune-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার সন্ধ্যায় ৫০–৬০ জনের একটি দল ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা’ লেখা বড় ব্যানার নিয়ে বেরোয়। মিছিলটি ভিসি চত্বর, চারুকলা, ক্যাম্পাসের মূল সড়ক ঘুরে টিএসসি রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশে গিয়ে দাঁড়ায়। সমাবেশে কেন্দ্রীয় সাহিত্য ও প্রকাশন সম্পাদক আবু সাদিক কায়েম এবং ঢাবি শাখা সভাপতি এস এম ফরহাদ সরকারকে হুমকিসদৃশ ভাষায় ‘খুনি হাসিনা ও দোসরদের বিচারের’ দাবি জানাতে শোনা যায়। পুরো কর্মসূচি ৩০–৩৫ মিনিট স্থায়ী হলেও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ চোখে পড়েনি; বরং দূর থেকে প্রক্টরিয়াল টিম ও শাহবাগ থানার পুলিশ মিছিল পর্যবেক্ষণ করে।

প্রতিক্রিয়া

ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুব ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “ক্যাম্পাসে অনুমতি ছাড়া কোনও রাজনৈতিক মিছিল করার সুযোগ নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, প্রয়োজনে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” অন্যদিকে ছাত্রলীগের ঢাবি ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক সজীব সরকার বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, “শিবিরের উসকানিমূলক স্লোগান ক্যাম্পাসের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্টের অপচেষ্টা।” জাসদ ছাত্রলীগ ও প্রগতিশীল ছাত্রজোট লিখিত বিবৃতি দিয়ে প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মিছিলের ভিডিও বিশ্লেষণ করে সহিংস উসকানি ছিল কি না, তা যাচাই করা হচ্ছে।”

বিশেষজ্ঞদের মতামত

গণতন্ত্র ও শাসনধারা বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক তানভীর আহমেদ মনে করেন, “শিবিরের এই আকস্মিক আগমন আসন্ন জাতীয় রাজনীতির আলোচনায় ইসলামী দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকার ইঙ্গিত দিচ্ছে।” নিরাপত্তাবিশ্লেষক শেখ কামাল বলেন, “ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা একটি সংগঠনের এমন প্রকাশ্য জমায়েত প্রশাসনিক নজরদারির ফাঁকফোকরও নির্দেশ করে।” অপরাধ সমাজবিজ্ঞানী ড. রিফাত ফেরদৌস পর্যবেক্ষণ দেন, “রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান যখন শহরের বাইরে ততটা কঠোর থাকছে না, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্পেস তৈরি হয়; সেটিই আজ আমরা দেখলাম।”

এরপর কী

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিমধ্যে প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছে, যাতে রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে পূর্ব অনুমতি ব্যবস্থা জোরদার ও সিসিটিভি কভারেজ বাড়ানো হয়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরূপণে ইউনিভার্সিটি সিকিউরিটি ফোর্সকে অতিরিক্ত টহল দিতে বলা হয়েছে। শিবিরের পক্ষ থেকে অবশ্য আরও ‘শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি’র পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা ক্যাম্পাস রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক পদক্ষেপ, সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপ এবং ক্যাম্পাসে সহিংসতা-জিরো টলারেন্স নীতি ছাড়া স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

More From Author

কাঁঠাল-মুড়ি খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু, বাড়ির খাবার নিরাপত্তা প্রশ্নে আলোচনায়

যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫% পাল্টা শুল্ক নিয়ে ঢাকার নীরবতা, অনিশ্চয়তায় রপ্তানি খাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *