গোপালগঞ্জের হামলাকে ঘিরে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম, তিন দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হুঁশিয়ারি
গত বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার শাহবাগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন (বিবা্ছা) ঘোষণা দেয়, গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতাদের বহরে বর্বর বোমা‒গুলি হামলার প্রতিবাদে তারা আওয়ামী লীগ–সমর্থিত ‘সন্ত্রাসীদের’ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার, ‘জুলাই ঘোষণা-পত্র’ প্রকাশ ও পুলিশ কাঠামোগত সংস্কার–এই তিন দফা দাবি করেছে। সংগঠনের সভাপতি রিফাত রশিদ বলেন, “আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কাউকেই আমরা আইনের বাইরে দেখতে চাই না।” তিনি জানান, দাবি না মানলে চলমান গণপরিবহন অবরোধ আরও কঠোর হবে।
এদিকে হামলার টার্গেট ছিলেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম—বুধবার ভোরে ফেসবুক পোস্টে অভিযোগ করেন এনসিপি নেতা আরিফুর রহমান তুহিন। বিস্ফোরণে চারজন গুরুতর আহত ও একজন নিখোঁজ রয়েছেন। পুলিশ আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না করলেও স্থানীয় হাসপাতাল সূত্রে ছয়জনকে ভর্তি করার তথ্য পেয়েছে আমাদের সময় পত্রিকা।
ঘটনাপ্রবাহ
মঙ্গলবার গভীর রাতে গোপালগঞ্জ সদর থেকে টুঙ্গিপাড়া সড়কে এনসিপি নেতাদের তিনটি গাড়িবহর লক্ষ্য করে তাজা বোমা ও গুলি ছোড়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যারিকেড, পোড়া গাড়ির অংশ ও বিস্ফোরকের ধোঁয়া দেখা যায়। এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন দাবি করেন, “রাস্তায় আগেই গান পাউডার ছড়ানো ছিল, গাড়ি থামতেই চার দিক থেকে হামলা শুরু হয়।” জেলা পুলিশ সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, তারা ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করছে, তবে এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
প্রেক্ষাপট
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নতুন প্রজন্মের কিছু রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘সরকারবিরোধী একক মঞ্চ’ তৈরিতে কাজ করছে; এনসিপি এবং বিবা্ছা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এনসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত না হলেও ঢাকাসহ কয়েকটি বিভাগীয় শহরে কর্মসূচি দিচ্ছে। অন্যদিকে বиба্ছা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রদের সংগঠন, যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ একাধিক ইস্যুতে রাস্তায় নেমেছে। দুই সংগঠনই ‘একদলীয় দখলদারিত্ব’ এবং ‘প্রশাসনে দলীয়করণ’–এর অভিযোগে সরকারের সমালোচক। বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই সংগঠনগুলোকে ‘ফ্রিঞ্জ’ বললেও মাঠরাজনীতিতে তাদের উপস্থিতি ক্রমে দৃশ্যমান।
প্রতিক্রিয়া
হামলার পর বиба্ছা দ্রুত রাজধানীতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে এবং শাহবাগে সংবাদ সম্মেলন ধরে। বিএনপিসহ কয়েকটি বিরোধী দল ফেসবুক বার্তায় সংহতি জানালেও আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিং করেনি। আওয়ামী লীগ বা যুবলীগ থেকে কেউ প্রকাশ্যে মন্তব্য করেনি। সরকারঘনিষ্ঠ ছাত্রলীগ নেতারা অনানুষ্ঠানিকভাবে এটিকে ‘নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল’ বলে দাবি করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কেউ এখনো গণমাধ্যমের সামনে মন্তব্য দেননি; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও নীরব।
বিশ্লেষণ
বিবা্ছার তিন দফার মধ্যে ‘জুলাই ঘোষণা-পত্র’ সবচেয়ে আলোচিত। সংগঠনটি সেখানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার, বাহিনী ও প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কার ও মানবাধিকার নিশ্চিতে ২১ দফা রূপরেখা যুক্ত করতে চায়। বিশ্লেষক ড. আলতাফ হোসেন মনে করেন, “দাবিগুলো আদতে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ; ছাত্রদের ব্যানার ব্যবহার করে জনমনে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোই উদ্দেশ্য।” অপর দিকে পুলিশ কাঠামো ভাঙার দাবি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর সরাসরি চাপ তৈরি করবে। এতে মাঠপর্যায়ে সংঘাত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না পর্যবেক্ষকেরা।
এরপর কী
২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষ হবে আজ বৃহস্পতিবার রাত আটটায়। এর পরদিন শুক্রবার জুমার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে ‘অবরোধ ঘেরাও’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিবা্ছা। তারা সারা দেশে জেলা প্রশাসক কার্যালয় ঘেরাওয়ের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। এনসিপি ইতিমধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হলে শনিবার বেলা ১১টায় গোপালগঞ্জ শহরে প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, উভয় কর্মসূচি পাল্টাপাল্টি অবস্থানে গিয়ে সহিংসতার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
বৃহত্তর চিত্র
নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণার সময়সূচি দিতে পারে। এর আগে ছাত্র-যুবভিত্তিক প্রতিবাদ জোরালো হওয়ার নজির রয়েছে—৯০-এর পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও তা দেখা গিয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলোর পথে নামা, রাজপথে ছাত্রদের সক্রিয় হওয়া এবং পুলিশের সাম্প্রতিক কঠোর অবস্থান মিলিয়ে ২০২4 সালজুড়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক তাপমাত্রা বাড়তেই পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।