আফগান পুনর্বাসন তথ্য ফাঁস: ব্রিটেনে অস্থিরতার আশঙ্কা, সরকারের জরুরি ব্যবস্থা
যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে পরিচালিত আফগান রিলোকেশন ও অ্যাসিস্ট্যান্স পলিসি (ARAP)–এর গোপন নথি ফাঁস হওয়ার পর মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) আদালতের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হলে বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। এতে ৮০ হাজার–এক লাখ আফগান, যাদের অনেকেই ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগী, তাদের পরিচয় ও ঠিকানা প্রকাশ পায়। সরকারের আশঙ্কা, তথ্য ফাঁস এবং নতুন করে আসা পুনর্বাসন খরচের খবরকে ঘিরে উগ্র-ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলো ফের সহিংস বিক্ষোভ ডাকতে পারে, যেমনটা ঘটেছিল গত গ্রীষ্মে তিন শিশুকে হত্যাকে কেন্দ্র করে। হোয়াইটহল ইতোমধ্যে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে এবং সম্ভাব্য দাঙ্গা ঠেকাতে পুলিশ, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় জোরদার করছে।
প্রেক্ষাপট
২০০১-২০২১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মোতায়েন ব্রিটিশ বাহিনীকে যে দোভাষী, দপ্তর সহকারী বা নিরাপত্তা কর্মীরা সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০২১ সালে চালু হয় ARAP। একই সঙ্গে Afghan Citizens Resettlement Scheme (ACRS)-এর মাধ্যমে আরও ২০ হাজার মানুষকে আনার টার্গেট ছিল। কিন্তু একাধিক পর্যায়ে গাফিলতি ও সর্বশেষ তথ্য ফাঁসের ফলে প্রকল্প দুটি কঠিন চাপে পড়ে। আদালতের নথি বলছে, তথ্য তালেবানের হাতে গেলে বিস্তর হয়রানি, নির্যাতন ও প্রাণহানির ঝুঁকি আছে।
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• এখন পর্যন্ত ৪,৫০০ আফগান সরাসরি যুক্তরাজ্যে পৌছে গেছেন, আর প্রায় ৬০০ জন পরিবারসহ ট্রানজিটে আছেন।
• মোট খরচ ইতিমধ্যে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড ছাড়িয়েছে; সমাপ্ত হতে পারে ৮৫০ মিলিয়ন পাউন্ডে।
• প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ হিসাব পূর্ণ পুনর্বাসন ব্যয় ৭ বিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত গড়াতে পারে।
• তথ্য ফাঁসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৮০,০০০–১০০,০০০, যার মধ্যে প্রায় ১৯,০০০ সরাসরি তালেবানের ‘টার্গেট তালিকায়’ থাকতে পারেন।
প্রতিক্রিয়া
রয়টার্স ও দ্য টেলিগ্রাফ জানায়, তথ্য প্রকাশের পর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার, লিডস, নিউক্যাসল এবং বস্টন এলাকাকে ‘উচ্চ ঝুঁকির’ তালিকায় রেখেছে হোম অফিস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ও ফেসবুক গোষ্ঠীগুলো ইতিমধ্যে ‘অবৈধ শরণার্থী ঠেকাও’ স্লোগান ছড়াতে শুরু করেছে। ব্রিটেনের মুসলিম, বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি কমিউনিটিতে আতঙ্ক বাড়ছে; মসজিদ ও হোটেলভিত্তিক আশ্রয়কেন্দ্রে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। লেবার পার্টি বিষয়টিকে ‘ব্যবস্থাগত ব্যর্থতা’ বলে আখ্যা দিলেও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ক্যারোলাইন নিকোলসন বলেন, ‘প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক আফগানকে দ্রুত উদ্ধারে সহযোগিতা করা।’
বিশ্লেষণ
মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষক মার্টিন জেমসনের মতে, ‘ডেটা লিক কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়, সামাজিক আস্থা ও শাসনব্যবস্থার ওপরও বড় ধাক্কা।’ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, লো-গ্রোথ ও জীবনযাত্রা ব্যয়ের চাপের মধ্যে আরও সরকারি খরচ বাড়লে জনবিক্ষোভ উসকে দিতে পারে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, অপসারণ বা প্রকল্প বন্ধ না করে স্বচ্ছ অধিবেশন ও সংসদীয় পর্যবেক্ষণ বাড়ানোই সংকট নিরসনের পথ।
এরপর কী
১ জুলাই থেকে ARAP-এ নতুন আবেদন বন্ধ; পূর্বের আবেদনগুলো ধীরগতিতে প্রক্রিয়াকরণ চলবে। সরকার তিন ধাপে—(১) তালেবানের ঝুঁকিতে থাকা পরিবার দ্রুত স্থানান্তর, (২) তথ্য ফাঁসের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা, (৩) সাইবার নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণ—ঘোষণা করেছে। সেপ্টেম্বরে সংসদীয় স্বরাষ্ট্র কমিটিতে পূর্ণ শুনানি হওয়ার কথা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, দ্রুত ফলাফল না এলে উগ্র-ডানপন্থি সংগঠনগুলো শীতকাল ঘিরে বড় সমাবেশ ডাকতে পারে, যা শুধু অভিবাসন নয়, সামগ্রিক সামাজিক অস্থিরতায় রূপ নেবে।