চট্টগ্রামে ওএমএস চাল-আটা আত্মসাৎ: ডিলারের বরাদ্দ স্থগিত ও ২৯ হাজার টাকা জরিমানা
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে সরকার পরিচালিত ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কর্মসূচির চাল ও আটা গোপনে বেশি দামে বিক্রি করে নিম্নবিত্ত ভোক্তাদের হাতে পচা চাল তুলে দিচ্ছিলেন ডিলার মো. ফিরোজ উদ্দিন। বুধবার সকাল ৯টায় ‘ফিরোজ ট্রেডিং’-এ হানা দিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের একটি ভ্রাম্যমাণ দল ১৩৮ কেজি চাল ও ১৫৩.৬৫ কেজি আটা কম পায়। নিয়মভঙ্গের দায়ে তার বরাদ্দ তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করা হয় এবং বাজারমূল্যের দ্বিগুণ হিসেবে ২৯,৯০৭ টাকা জরিমানা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। অধিদপ্তর ঢাকায় ডিলারশিপ বাতিল ও আত্মসাতের মামলা করার সুপারিশ করেছে।
পটভূমি
ওএমএস কার্যক্রমে সরকার চলতি মৌসুমে প্রতিকেজি চাল ৩০ টাকায় ও আটা ২৪ টাকায় বিক্রি করছে, যাতে নিম্ন ও স্বল্প আয়ভুক্ত মানুষ ন্যায্যমূল্যে খাদ্য পেয়ে থাকে। ৪১ ওয়ার্ডের নতুন ডিলার নিয়োগে গত মাসে চট্টগ্রামের জালালাবাদ ওয়ার্ডে সুযোগ পান মো. ফিরোজ উদ্দিন। নিয়ম অনুযায়ী ডিলারকে দৈনিক স্টক ও বিক্রির তথ্য মাস্টার রোলে আপডেট রাখতে হয়। খাদ্য বিভাগের পরিদর্শনে বুধবার দেখা যায়, ঘোষিত স্টকের সঙ্গে প্রকৃত মজুদের বড় বৈষম্য রয়েছে এবং বিক্রির জন্য রাখা বস্তাগুলোর চাল ‘গরুর খাদ্যের যোগ্য নয়’—বলেছেন আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এস. এম. কায়সার আলী।
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• আত্মসাৎ করা চাল: ১৩৮ কেজি
• আত্মসাৎ করা আটা: ১৫৩.৬৫ কেজি
• আর্থিক জরিমানা: ২৯,৯০৭ টাকা (মৌলিক দামের দ্বিগুণ)
• ওএমএসে নির্ধারিত মূল্য: চাল ৩০ টাকা/কেজি, আটা ২৪ টাকা/কেজি
• অভিযান চলাকালে ধরা পড়া মোট অনিয়ম: ২৯২ কেজি খাদ্যশস্য
প্রতিক্রিয়া
ডিলার ফিরোজ উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে ‘গুদামের হিসাবের ভুল’ দাবি করেছেন, তবে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তা আমলে নেননি। স্থানীয় ভোক্তারা বলেন, “লাইন ধরেও ভালো চাল পাইনি, দামও বাড়তি চাইত।” চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কায়সার আলী সাংবাদিকদের জানান, “ভিডিওতে দেখা চাল মানুষের খাবার দূরের কথা, পশুখাদ্যের যোগ্যও নয়। এটাই প্রমাণ করে সরকারি চাল বাইরে বিক্রি করে নিম্নমানের চাল ভোক্তাদের দেওয়া হচ্ছিল।” ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বাজারে রেশনের চাল ফাঁস হলে পুরো ভর্তুকি ব্যর্থ হয়; এমন ঘটনা কয়েক মাস ধরেই ছড়িয়ে পড়ছে।”
বিশ্লেষণ
দেশজুড়ে মূল্যস্ফীতি যখন দীর্ঘমেয়াদে ৯ শতাংশের কাছাকাছি, তখন ওএমএসই নিম্নআয়ের মানুষের শেষ ভরসা। কিন্তু তদারকি দুর্বল থাকায় ডিলাররা লাভের আশায় চাল ফুঁসিয়ে বাইরে বিক্রি করছেন, যা শুধু ভোক্তার অধিকার নয়, রাষ্ট্রের ভর্তুকি তহবিলকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আহসান বলেন, “সাবসিডি প্রোগ্রামে ঘাটতি রোধে ই-পোস মেশিন, রিয়েল-টাইম স্টক মনিটর ও কঠোর শাস্তি জরুরি। না হলে বাজারে কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি হয় এবং খোলাবাজারে দাম আরও বাড়ে।” গত তিন মাসে ঢাকাসহ অন্তত পাঁচটি জেলায় ওএমএস অনিয়ম ধরা পড়েছে, যা নীতি বাস্তবায়নে ব্যবস্থাগত দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়।
পরবর্তী পদক্ষেপ
খাদ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ফিরোজ ট্রেডিংয়ের জরিমানার টাকা বৃহস্পতিবারের মধ্যে কোষাগারে না গেলে চূড়ান্তভাবে ডিলারশিপ বাতিল করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি নগরের অন্য ৪০ ওয়ার্ডে একযোগে আকস্মিক পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ই-ট্রাকিং ব্যবস্থা চালুর ওপর জোর দিয়েছে, যাতে স্টক ও বিক্রির তথ্য মোবাইল অ্যাপে লেনদেনভিত্তিক দেখা যায়। জেলা প্রশাসনও স্বেচ্ছাসেবক দল ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে যুক্ত করে ‘চোখ রাখুন’ কর্মসূচি চালু করবে বলে জানা গেছে—লক্ষ্য, আগামী মাসের মধ্যে প্রতিটি ডিলার পয়েন্টে সিসিটিভি ও ডিজিটাল ওজন মেশিন বসানো।