গোপালগঞ্জে এনসিপি সমাবেশে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, কারফিউ জারি

গোপালগঞ্জে এনসিপি সমাবেশে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, কারফিউ জারি

বুধবার ভোর থেকে গোপালগঞ্জ শহর জুড়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটে। পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ দিয়ে যে বিশৃঙ্খলার শুরু, সেটি দ্রুতই আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ কর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং এনসিপি সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। হাতবোমার বিস্ফোরণ, গুলির শব্দ আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে দোকানপাট বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। দুপুরে ১৪৪ ধারা, রাতে শহরজুড়ে কারফিউ (রাত ৮টা–পরদিন ৬টা) ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন; মোতায়েন করা হয় সেনা, র‍্যাব ও চার প্লাটুন বিজিবি। গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে রাতে চারজনের মরদেহ পৌঁছায়, ঢাকায় নেয়া হয় আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ। সংঘর্ষের মধ্যেই সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে শহর ত্যাগ করেন এনসিপির শীর্ষ নেতারা। দলটি বৃহস্পতিবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ ডাকেছে, হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী জোট। প্রশাসন বলছে, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও উত্তেজনা অব্যাহত।

ঘটনাপ্রবাহ

সকাল সাড়ে ৯টায় এনসিপির গাড়িবহর শহরে ঢোকার আগেই পুলিশ ভ্যানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বেলা দেড়টার দিকে পৌরপার্ক মাঠে সমাবেশ মঞ্চে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একটি মিছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। পাল্টা প্রতিরোধে এনসিপি সমর্থকরাও জড়ো হলে শুরু হয় ইটপাটকেল, পরে দেশি হাতবোমা ও সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ।

সভা পণ্ড হয়ে গেলে নেতারা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। দুপুর দুইটায় সদর ইউএনওর গাড়িতেও হামলা হয়। বিকেল চারটায় জেলা কারাগারের ফটক ভাঙচুরের চেষ্টা করলে সেনা-পুলিশ গুলি ছুড়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে। সন্ধ্যা নামার আগে শহরের লঞ্চঘাট ও কলেজ মোড়ে ফের সংঘর্ষ হয়। রাত আটটায় কারফিউ কার্যকর হলে টহল বাড়ে, রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়।

পটভূমি

বিপ্লবী ‘জুলাই আন্দোলন’-এর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এনসিপি ১৫ জুলাই থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে পথসভা করছে। গোপালগঞ্জ—পূর্বে আওয়ামী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত—ছিল এ সফরের গুরুত্বপূর্ণ পড়ন্ত। সামাজিক মাধ্যমে দিনভর ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ প্রচারের জেরে মঙ্গলবার রাত থেকেই উত্তেজনার পারদ চড়ে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে ‘নিষিদ্ধ সংগঠন’ ঘোষণার পরও তারা প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং করছে—এ অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে উঠছে বিরোধী শিবিরের। এবার সেই সাংগঠনিক দ্বন্দ্ব সরাসরি রাস্তায় রক্তক্ষয়ী রূপ নিল।

গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা

• নিহত: ৪ (গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল; পুলিশ আরও প্রাণহানির আশঙ্কা করছে)

• গুলিবিদ্ধ: অন্তত ১২; ঢামেকে ভর্তি ১ জনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন (ঢামেক পুলিশ ক্যাম্প)

• নিরাপত্তা বাহিনী: সেনা, র‍্যাব, পুলিশ ও ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

• সময়সূচি: রাত ৮টা (১৬ জুলাই) থেকে পরদিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ

• শিক্ষা: বৃহস্পতিবারের এইচএসসি ভূগোল (২য় পত্র) পরীক্ষা স্থগিত—ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বিজ্ঞপ্তি

• কর্মসূচি: ১৭ জুলাই এনসিপি-র দেশব্যাপী বিক্ষোভ, একই দিনে জামায়াতের সমাবেশ ঘোষণা

প্রতিক্রিয়া

ইন্টারিম (অন্তর্বর্তী) সরকার এক বিবৃতিতে ঘটনাকে ‘মানবাধিকারের লজ্জাজনক লঙ্ঘন’ উল্লেখ করে দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং সেনা-পুলিশের হস্তক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছে।

খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি কায়দায় হামলা চালানো হয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার না হলে বড় কর্মসূচি আসছে।” আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিলেও স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ঘটনাকে ‘উস্কানিমূলক সমাবেশের পরিণতি’ বলে উল্লেখ করেন।

রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ পৃথক বিক্ষোভ করে; জামায়াত বৃহস্পতিবার সারা দেশে মানববন্ধন ও বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ‘গোপালগঞ্জ ইন্দোনেশিয়া না’—হ্যাশট্যাগে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

এরপর কী

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ভোরে পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে কারফিউ শিথিল করা হতে পারে, তবে ১৪৪ ধারা বহাল থাকবে। পুলিশ ফৌজদারি মামলা প্রস্তুত করছে, সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এনসিপি তাদের পরের পথসভা বৃহস্পতিবার ফরিদপুরে করতে চায়, কিন্তু প্রশাসনের ‘নিরাপত্তা মূল্যায়ন’ এখনো শেষ হয়নি। শিক্ষা বোর্ড পরিবর্তিত পরীক্ষার তারিখ পরে জানাবে। রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামনে পৌনে-দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন; এমন সংঘর্ষ যদি নিয়মিত চেহারা নেয়, তা হলে নির্বাচন পূর্ব সহিংসতার শঙ্কা বেড়েই যাবে।

More From Author

কলম্বোর রূপকথা: লঙ্কান মাটিতে প্রথম সিরিজ জয়ে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ

৫ কোটি শুল্ক ফাঁকি: চট্টগ্রামে সি অ্যান্ড এফ মালিকের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *