সকালের নাস্তা বাদ দিচ্ছেন? ৩টি ভুল বদলালেই ঝুঁকি কমবে
দীর্ঘ উপবাসের পর শরীরের দিনভর শক্তি জোগায় ব্রেকফাস্ট। কিন্তু ব্যস্ততা, ভুল ধারণা এবং সহজ পথে হাঁটার ফলে বহু মানুষ সকালে নাস্তা না খাওয়া, শুধু চা–কফি খেয়ে থাকা বা অতি প্রসেসড মিষ্টিজাত খাবার বেছে নেওয়ার মতো তিনটি সাধারণ ভুল করছেন। পুষ্টিবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অভ্যাস বদলাতে না পারলে রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা থেকে শুরু করে হজমের জটিল সমস্যা পর্যন্ত তৈরি হতে পারে। ঢাকার কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চালানো সমীক্ষায় দেখা গেছে, অফিসপাড়ার প্রায় ৪২% কর্মী নিয়মিত ব্রেকফাস্ট এড়িয়ে যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং বাংলাদেশ নিউট্রিশন সোসাইটি ১৭ জুলাই প্রকাশিত পৃথক প্রতিবেদনে সতর্ক করেছে, ‘দিনের প্রথম খাবার’ অবহেলা করলে কর্মক্ষমতা ও মানসিক সামর্থ্যও দ্রুত কমে।
প্রেক্ষাপট
রাতের টানা ৮–১০ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সকালের নাস্তা জরুরি। বাংলাদেশ ব্রেস্টফাস্ট হ্যাবিট স্টাডি-২০২৪ অনুযায়ী ঢাকায় ২৫–৪০ বছর বয়সী মানুষের ৩৮%-ই নির্দিষ্ট নাস্তা খান না। শহুরে কর্মব্যস্ততা, ওজন কমানোর গুজব ও ক্যাফেইননির্ভরতা এই প্রবণতা বাড়াচ্ছে। ফল: দুপুরে অতিরিক্ত খাওয়া, বিপাকক্রিয়া শ্লথ হওয়া এবং দ্রুত ক্লান্তি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
পুষ্টিবিদ ডা. রীতা রাহমান জানাচ্ছেন, খালি পেটে চা-কফি পাকস্থলীতে এসিড বাড়ায়; দীর্ঘমেয়াদে আলসার ও অ্যাসিড রিফ্লাক্সের ঝুঁকি ৩০% পর্যন্ত বাড়ায়। বিএসএমএমইউ-র গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘প্রসেসড সিরিয়াল বা কেক-পেস্ট্রিতে অতিরিক্ত চিনি ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যা রক্তে শর্করা হঠাৎ বাড়িয়ে আবার কমিয়ে দেয়—এর ফলেই সকালেই ঝিমুনি।’ তাঁর পরিষ্কার পরামর্শ, নাস্তার থালায় ৪৫-৫০% শস্য (লাল আটার রুটি/ওটস), ২৫% প্রোটিন (ডিম/ডাল/চিকেন) ও বাকি অংশে ফল কিংবা বাদাম রাখা।
কিভাবে এই পর্যন্ত এলাম
দশক দুয়েক আগে পর্যন্ত শহরে পাতলা খিচুড়ি, চিড়া-দই কিংবা গুড়-রুটি ছিল ঘরোয়া ব্রেকফাস্টের চিত্র। ফাস্ট-ফুড ব্র্যান্ড, ইনস্ট্যান্ট নুডলস ও ইনস্ট্যান্ট কফি সংস্কৃতি সেই ধারা ভেঙে দেয়। করোনার সময়ে ঘরে বসে কাজের চাপ বেড়ে নাস্তা আরও অনিয়মিত হয়। স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়লেও সোশ্যাল মিডিয়ার ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ ট্রেন্ড ভুলভাবে অনুসরণ করে অনেকে সকালটা একেবারে উপোস থাকেন।
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• ৪২%: ঢাকায় নিয়মিত নাস্তা বাদ দেওয়া অফিসকর্মীর হার (জিএনএস জরিপ ২০২৪)
• ৩৩%: খালি পেটে কফির ওপর নির্ভরশীল কর্মজীবী নারী
• ২.১ গুণ: নিয়মিত নাস্তা-বিমুখদের ওজন বাড়ার ঝুঁকি (ডব্লিউএইচও মেটা-অ্যানালাইসিস)
• ৫৫ মিনিট: নাস্তা বাদ দিলে দুপুরের খাবার সময় গড়ে আগেভাগে খাওয়া শুরু হয়, ফলস্বরূপ অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ
ভোক্তাদের উপর প্রভাব
নাস্তা-বিমুখদের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক ও টেনশন-হেডেকের ওষুধ বিক্রি ২০২৩ সালে ১৮% বেড়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। কর্মদক্ষতার দিকেও প্রভাব সুস্পষ্ট: একটি বহুজাতিক কলসেন্টারের ভেতরের সমীক্ষায় দেখা যায়, যারা সকাল ৯টার মধ্যে কমপ্লেক্স কার্ব ও প্রোটিন-সমৃদ্ধ নাস্তা খান, তাদের কল-হ্যান্ডেলিং টাইম গড়ে ১১% কম।
এরপর কী
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পুষ্টি সেল ইতিমধ্যে ‘সকালের নাস্তা স্বাস্থ্যকর হোক’ শিরোনামে একটি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। স্কুল-কলেজের মিড-মর্নিং বিরতিতে ফল-ডিম-বাদামের বিকল্প দেওয়ার প্রস্তাবও বিবেচনায় আছে। পাশাপাশি কর্পোরেট অফিসে ভিটামিন-সমৃদ্ধ কম প্রসেসড খাবার সরবরাহ করতে প্রণোদনা দিতে চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
শেষ কথা
নাস্তা কখন খাব, কী খাব—এ সিদ্ধান্তটা অবহেলার নয়, বরং দৈনিক বিনিয়োগ। বিনিয়োগটা সঠিক হলে সারাদিন মুনাফা মেলে প্রাণশক্তি আর মনোযোগে। তাই চা-কফিকে সঙ্গী করতে চাইলে সঙ্গে রাখুন ডিম-ওটস বা ফল; ব্যাগভর্তি প্যাকেটজাত মিষ্টি নয়। ছোট বদলেই বড় সুফল—সকালের নাস্তা হোক দিন বদলের প্রথম ধাপ।