গর্ভাবস্থায় সাইকেডেলিক মাশরুম নিয়ে বিতর্ক: আদিবাসী জ্ঞান বনাম বিজ্ঞান
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা মিকােলা ছয় বছর আগে মা হতে গেলে অ্যালকোহল ছেড়ে দেন, কিন্তু মানসিক ট্রমা সামলাতে তিনি ভরসা করেন ‘ম্যাজিক মাশরুমে’ থাকা সাইকেডেলিক পদার্থ পাইসিলোসাইবিনের ওপর। গর্ভাবস্থায় ম্যান্ডেট করা ওষুধ বা অ্যান্টিসাইকোটিকের বদলে তিনি খোঁজেন আদিবাসী মেক্সিকান প্রথা, যেখানে নিয়মিত ধ্যান ও আচার-অনুষ্ঠানে মাশরুম ব্যবহারের ইতিহাস রয়েছে। একই সময়ে তিনি ও সহকর্মীরা ৪০০-এর বেশি মায়ের ওপর একটি অনানুষ্ঠানিক জরিপ চালিয়ে দেখেন— pregnancy কিংবা স্তন্যদান চলাকালে পাইসিলোসাইবিন গ্রহণে বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তথ্য নেই, বরং অনেকেই বিষণ্নতা কমার অভিজ্ঞতা জানান। তবে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবশিশুর ওপর প্রভাব নিয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণা না হওয়া পর্যন্ত এটিকে ‘নিরাপদ’ বলা যাবে না। অন্যদিকে ভারতের পুরুলিয়ায় বছরজুড়ে বানিজ্যিক মাশরুমচাষ শুরু হওয়ায় খাদ্য ও পুষ্টিগত সুবিধা ঘরে ঘরে পৌঁছানোর আশা দেখছেন উদ্যোক্তারা। মাশরুমের চিকিৎসা, পুষ্টি ও সংস্কৃতিগত ব্যবহার নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও সামাজিক কৌতূহল—দুটিই এখন তুঙ্গে।
পটভূমি
কৈশোরে যৌন সহিংসতার ট্রমা মোকাবিলায় মদ ও মাদক নির্ভর মিকােলা তাঁর ত্রিশের কোঠায় এসে আবিষ্কার করেন, বছরে কয়েকবার উচ্চ মাত্রার ও মাঝে মাঝে অতি ক্ষুদ্র মাত্রার (মাইক্রোডোজ) পাইসিলোসাইবিন তাঁর উদ্বেগ ও লজ্জাবোধ কমায়। কিন্তু সন্তানসম্ভবা হলে বিষয়টি ঘোলাটে হয়ে যায়—গর্ভের সন্তানের ওপর প্রভাব নিয়ে ইন্টারনেটে স্পষ্ট তথ্য ছিল না। তখনই তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদিবাসী নারী নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, জালিস্কো অঞ্চলের কিছু মেক্সিকান সম্প্রদায়ে গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীরা ঐতিহ্যগত আচার-অনুষ্ঠানে মাশরুম, পেওটে বা আয়াহুয়াসকা সেবন করেন। এই প্রথাগত জ্ঞানের ভিত্তিতে মিকােলা গভীর ধ্যানে অংশ নেন, সুস্থ সন্তান জন্ম দেন এবং নিজের অভিজ্ঞতাকে প্রামাণ্য করতে মাঠে নামেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. আনিতা ক্লেটন (ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) রয়টার্সকে বলেন, “গর্ভাবস্থায় যে–কোনো সাইকেডেলিককে আপাতত অসুরক্ষিতই ধরতে হবে, কারণ মানবপরীক্ষা নেই।” পশু গবেষণায় দেখা গেছে, পাইসিলোসাইবিন প্লাসেন্টা ভেদ করে ভ্রূণে পৌঁছাতে পারে, তবে ক্ষতির ধরন অজানা। অন্য দিকে নৃবিজ্ঞানী স্টেসি শেফার মনে করিয়ে দেন, মেক্সিকো ও ব্রাজিলের বহু আদিবাসী সমাজে শতবর্ষ ধরে এই উদ্ভিদভিত্তিক ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সেখানে উল্লেখযোগ্য জেনেটিক বা বিকাশগত ঝুঁকি প্রমাণিত হয়নি। দুই মেরুর এ বিতর্কই মূলত ‘গ্রীহস্থ’ জ্ঞান বনাম ‘গবেষণাগার’ জ্ঞানের সংঘাতকে সামনে আনে।
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• ৪০০+ মা: মিকােলা দলের অনানুষ্ঠানিক জরিপে অংশ নেন, যাঁদের সিংহভাগই মার্কিন নাগরিক।
• ১৫ দিন: ভারতের পুরুলিয়ায় নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ‘পোয়াল ছাতু’ মাশরুম সংগ্রহের সময়, যা বছরের যে কোনো সময় সম্ভব।
• ৪–৫ কেজি: একেকটি খড়ের স্তূপ থেকে মাশরুমের সম্ভাব্য ফলন, উদ্যোক্তাদের হিসাব।
• ৩০–৪০%: পুষ্টিবিদদের মতে, রান্না করা মাশরুমে দৈনিক প্রোটিন চাহিদার যত অংশ পূরণ হতে পারে।
• শূন্য নিয়ন্ত্রিত মানবচিকিৎসা পরীক্ষা: এখন পর্যন্ত গর্ভাবস্থায় পাইসিলোসাইবিনের নিরাপত্তা বুঝতে।
বৃহত্তর চিত্র
একদিকে পশ্চিমা দেশে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসায় সাইকেডেলিক ওষুধকে মূলধারায় আনার চাপ বাড়ছে; অন্য দিকে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ অর্থনীতিতে মাশরুম এখন বিকল্প আয় ও পুষ্টির উৎস। পুরুলিয়ার সফল পরীক্ষামূলক চাষ দেখাচ্ছে, নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ব্যবস্থাপনা জানলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি সত্ত্বেও বছরজুড়ে উৎপাদন সম্ভব। বিশ্ববাজারে ২০২২ সালে মাশরুম শিল্পের আকার ছিল প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার; ২০২৭-এর মধ্যে তা দ্বিগুণের কাছাকাছি যেতে পারে বলে পূর্বাভাস। ফলে চিকিৎসা ও খাদ্য—দুই খাতে গবেষণা-বাণিজ্যের সংযোগ বাড়ছে।
এরপর কী
মিকােলার দল ইতিমধ্যে এক জন পিএইচডি গবেষকের তত্ত্বাবধানে জরিপটিকে গুণগত গবেষণার কাঠামোয় রূপ দিতে কাজ করছে, যাতে পিয়ার-রিভিউড সাময়িকীতে প্রকাশযোগ্য হয়। একই সঙ্গে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) গর্ভাবস্থায় সাইকেডেলিক ব্যবহারের ওপর আনুষ্ঠানিক সতর্কতা জারি করার সম্ভাবনা যাচাই করছে। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ায় মাশরুম উৎপাদকরা সরকারি ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণ দাবি করছেন, যাতে খাদ্য-নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যে এর সুবিধা সর্বজনীন হয়। সামনের ধাক্কা হবে—বিজ্ঞান কি আদিবাসী জ্ঞানকে অনুসরণ করে নিরাপদ মাত্রা নির্ধারণ করতে পারবে, নাকি কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে? জবাব পেতে আরও ব্যাপক, বহুমাত্রিক গবেষণা ছাড়া উপায় নেই।