কাঁঠাল-মুড়ি খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু, বাড়ির খাবার নিরাপত্তা প্রশ্নে আলোচনায়
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার মামুদপুর গ্রামে বুধবার দুপুরে একই পরিবারের দুই শিশু—বাকি বিল্লাহ (৫) ও আছিয়া খাতুন (৪)—কাঁঠাল ও মুড়ি খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায়। স্থানীয় পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, দু’দিন আগে নানাবাড়ি থেকে আনা বড় কাঁঠালের বাকি অংশ মেঝেতে রাখা ছিল; পরদিন সেই কাঁঠাল মুড়ির সঙ্গে মিশিয়ে খেয়েছিল সবাই। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকরা ঘটনাটিকে ‘খাদ্য বিষক্রিয়া’ বলে ধারণা করছেন। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে এবং গৃহস্থালি খাদ্য সংরক্ষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
মূল তথ্য
বুধবার (১৬ জুলাই) বেলা ১২টার দিকে দুই শিশুসহ পরিবারের সদস্যরা একই কাঁঠাল ও মুড়ি খান। আধা ঘণ্টার মধ্যেই বাকি বিল্লাহ ও আছিয়া বমি ও তীব্র পেটব্যথায় ছটফট করতে থাকে। তাঁদের দ্রুত এনায়েতপুরের খাজা ইউনুস আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলেও কর্তব্যরত চিকিৎসক দুপুর দেড়টার দিকে দু’জনকেই মৃত ঘোষণা করেন। শিশুদের বাবা নুরুল হক স্থানীয় একটি তাঁত কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। পুলিশ বলছে, মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে মরদেহ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে এবং বাড়ি থেকে কাঁঠালের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
প্রেক্ষাপট
দেশে বাড়ির খাবার থেকে মারাত্মক অসুস্থতার ঘটনা আগেও ঘটেছে, তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি গবেষণা এ বিষয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় জনপ্রিয় ‘সোনালি’ মুরগির মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ইসচেরিশিয়া কোলাই (ই. কোলাই) শনাক্ত হয়েছে (প্রকাশ: নেচার, ২০২4)। অপরদিকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষায় দেখা গেছে, ফ্রিজে লম্বা সময় খোলা পাত্রে রাখা ফল ও রান্না করা খাবারে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা—বিশেষ করে মেঝেতে বা খোলা জায়গায় রাখা কাঁঠালের মতো উচ্চ চিনিযুক্ত ফল—ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন (সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আইইডিসিআর) রায়টার্সকে জানান, "স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ৪–৬ ঘণ্টার বেশি সময় ফল বা রান্না করা খাবার খোলা অবস্থায় থাকলে টক্সিন উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়ে, যা শিশুরা সহ্য করতে পারে না।" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, "কাঁঠাল সহজে গাঁজন (fermentation) শুরু করে; এতে উৎপন্ন স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াসের টক্সিন ১০০°C তাপেও নষ্ট না-ও হতে পারে।" বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (BFSA) এর সদস্য সচিব কামরুল হাসান জানান, দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রয়োজনে স্থানীয় বাজারে খাদ্য নিরাপত্তা তদারকি বাড়ানো হবে।
এরপর কী
বেলকুচি থানা ও সিভিল সার্জন অফিস ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেবে। জেলার প্রতিটি হাসপাতালে খাদ্য বিষক্রিয়া চিকিৎসায় প্রস্তুতি বাড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গৃহস্থালি খাদ্য সংরক্ষণে তিনটি জরুরি পরামর্শ দিয়েছে: (১) কাটাকাঁঠাল বা অন্য ফল ২ ঘণ্টার মধ্যেই ফ্রিজে ৪°C-এর নিচে রাখতে হবে; (২) রান্নার আগে ও পরে হাত, ছুরি ও তাক সাবান-গরম পানিতে ধুতে হবে; (৩) শিশুদের জন্য বাসি খাবার অবশ্যই ভালভাবে গরম করে ৬৫°C-এর বেশি তাপমাত্রায় পরিবেশন করতে হবে। এলাকায় ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা লিফলেট বিতরণ শুরু করেছেন।
সংখ্যায় তথ্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগব্যাধি নজরদারি শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশজুড়ে খাবারজনিত ডায়রিয়া ও বিষক্রিয়ার ঘটনায় ৩৪ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়; এর ৬৫ শতাংশই ১০ বছরের কম বয়সী। বাজারে বিক্রি হওয়া গৃহস্থালি ফল-মূলের ২২ শতাংশ নমুনায় ক্ষতিকর জীবাণু ও ১২ শতাংশে কেমিক্যাল অবশিষ্ট পাওয়া গেছে (সূত্র: বিএসটিআই, ২০২3 সার্ভে)।