ভয়েস অব আমেরিকার জরিপে ভারত-পাকিস্তান নিয়ে বাংলাদেশিদের ভাবনা: পছন্দ, অপছন্দ ও কূটনৈতিক বার্তা

ভয়েস অব আমেরিকার জরিপে ভারত-পাকিস্তান নিয়ে বাংলাদেশিদের ভাবনা: পছন্দ, অপছন্দ ও কূটনৈতিক বার্তা

ঢাকাভিত্তিক ১,০০০ উত্তরদাতার ওপর ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৫৩.৬ শতাংশ বাংলাদেশি ভারতকে পছন্দ করেন, ৪১.৩ শতাংশ অপছন্দ করেন। একই জরিপে ৫৯ শতাংশ পাকিস্তানকে পছন্দের তালিকায় রেখেছেন, আর ২৮.৫ শতাংশ অপছন্দ করেছেন। প্রতিবেশী মিয়ানমারকে অপছন্দের হার ছিল সবচেয়ে বেশি—৫৯.১ শতাংশ। জরিপটি জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে অনলাইন ও ফোন-ভিত্তিক পদ্ধতিতে চালানো হয়েছে, ফলাফল মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) প্রকাশ করে কয়েকটি অনলাইন মাধ্যম।
ভারত-পাকিস্তান তুলনায় পাকিস্তান সামান্য এগিয়ে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র (৬৮.৪%), চীন (৬৬%) ও রাশিয়া (৬৪%)-কে নিয়ে বাংলাদেশের জনমত তুলনামূলকভাবে আরও ইতিবাচক। বিশ্লেষকদের মতে, ফলাফল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম বার্তা বহন করে, বিশেষত যখন সীমান্ত, বাণিজ্য বা সাংস্কৃতিক ইস্যুতে ঢাকা-নয়াদিল্লি আলোচনায় ব্যস্ত।

পটভূমি

বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্র সম্পর্কে গণমতের তথ্য নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয় না। ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা প্রথমবারের মতো বড় আকারে আট দেশ নিয়ে এই অনুসন্ধান চালায়। উত্তরদাতাদের ৫১ শতাংশ ছিলেন পুরুষ, ৪৯ শতাংশ নারী; বয়স ১৮ থেকে ৬৫-র বেশি। প্রশ্নপত্রে ‘খুব পছন্দ’, ‘পছন্দ’, ‘অপছন্দ’ ও ‘একেবারেই অপছন্দ’–এর মধ্যে বাছাই করতে বলা হয়। পরে ‘পছন্দ’ ও ‘খুব পছন্দ’কে পজিটিভ স্কোর, বাকি দুটিকে নেগেটিভ স্কোর ধরা হয়।

প্রতিক্রিয়া

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. সিফাত বিন আহমেদ মনে করেন, “ভারতকে ঘিরে সীমান্ত হত্যা, ট্রেড ইমব্যালান্স ও অনুপ্রবেশ–সংক্রান্ত বিতর্ক মিডিয়ায় বেশি চোখে পড়ে। এর প্রভাব জরিপেও পড়েছে।” জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা পারভীন বলেন, “পাকিস্তান নিয়ে নেতিবাচক ধারণা প্রজন্মগত; কিন্তু টিভি সিরিয়াল, ক্রিকেট ও সামাজিক মাধ্যমে নস্টালজিয়ার ফলে ‘পছন্দ’ স্কোর তুলনামূলক উঁচু থাকতে পারে।”

বিশ্লেষণ

জরিপে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য—চার বিশ্বশক্তিই ৬০ শতাংশের বেশি পজিটিভ স্কোর পেয়েছে। এর অর্থ, ঢাকা বহুমুখী সম্পর্ক বজায় রাখতে জনসমর্থন পাচ্ছে। মিয়ানমারকে অপছন্দের কারণ রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সীমান্তে গোলাগুলি—যা মিডিয়ায় নিয়মিত আলোচিত। একই দিনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ময়মনসিংহে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি ভাঙার সিদ্ধান্ত ‘পুনর্বিবেচনা’ করতে ঢাকাকে অনুরোধ করেছে, আবার মহেশপুরে বিএসএফ–বিজিবি পতাকা বৈঠক শেষে সাত বাংলাদেশি নাগরিক ফেরানো হয়েছে। এসব খবরে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের সংবেদনশীলতা তুলনামূলকভাবে সামনে এসেছে।

বৃহত্তর চিত্র

বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরেই ‘ইন্ডিয়া-ফার্স্ট’ নয়, ‘ব্যালান্সড’ ফরেন পলিসি অনুসরণ করছে—যেখানে বেইজিং, ওয়াশিংটন ও মস্কোর সঙ্গে সমান দূরত্ব রক্ষা করা হয়। জরিপের ফল দেখাচ্ছে, জনমতও একই ধারার পক্ষে। তবে ভারত সম্পর্কে অপছন্দের হার ৪১ শতাংশ হওয়া নীতিনির্ধারকদের জন্য সতর্ক বার্তা; সীমান্ত হত্যা রোধ, নদীর পানি বণ্টন ও ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার মতো মুলতুবি বিষয়ে অগ্রগতি না হলে অপছন্দের ধারা আরও পাকাপোক্ত হতে পারে।

এর গুরুত্ব কী

জনমত দুই দেশের সরকারকে সরাসরি縁 মাত করে না, কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নীতিনির্ধারণে ছায়া ফেলে। ২০২৬-এর মধ্যবর্তী সময়ে উভয় দেশই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী পর্যায় অতিক্রম করবে। ঢাকার জন্য জরিপটি ইঙ্গিত দেয়, পাকিস্তানের ওপর জনমত বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে না; বরং প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াতে জনগণ প্রস্তুত, শর্ত শুধু পারস্পরিক আস্থা। এজন্য ট্রেড গ্যাপ কমানো, শিক্ষার্থী ভিসা বাড়ানো ও সাংস্কৃতিক বিনিময় জোরদার করার পরামর্শ দেন পর্যবেক্ষকেরা।

পরবর্তী পদক্ষেপ

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও জরিপ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিলেও এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “জনমত সবসময় নজরে রাখা হয়। প্রতিবেশী নীতি যেন জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে, সেটাই লক্ষ্য।” গবেষকেরা আগামী বছরে বড়-মাপের আরেকটি জরিপ পরিচালনার তাগিদ দিয়েছেন, যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অঞ্চলভিত্তিক ও বয়সভিত্তিক বিভাজন বিশ্লেষণ করা যাবে।

More From Author

প্রথম ‘জুলাই শহীদ দিবস’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন: বৈষম্যহীন নতুন দেশে ঐক্যের ডাক প্রধান উপদেষ্টার

যুক্তরাষ্ট্র-ইন্দোনেশিয়া বাণিজ্য চুক্তি: ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে শুল্ক কমে ১৯ শতাংশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *