প্রথম ‘জুলাই শহীদ দিবস’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন: বৈষম্যহীন নতুন দেশে ঐক্যের ডাক প্রধান উপদেষ্টার
১৬ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘জুলাই শহীদ দিবস’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়েছে। দিবসটি স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং মসজিদ-মন্দির-গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীসহ সারাদেশে নানা কর্মসূচিতে অংশ নেন হাজারো মানুষ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস টেলিভিশন ও লিখিত বাণীতে বৈষম্য, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। সরকার শহীদ পরিবারের জন্য এককালীন ৩০ লাখ টাকা ও আজীবন ভাতা চালু করেছে এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর ও শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠিত হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই কোটা-বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলি ও সন্ত্রাসী হামলায় চট্টগ্রাম, রংপুর ও ঢাকায় অন্তত ছয়জন নিহত হন; পরে তা স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পথ খুলে দেয়।
পটভূমি
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিকেলে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের ‘বুকে গুলি করুন’ ডাক গোটা দেশে ঝড় তোলে। একই দিনে চট্টগ্রামের মুরাদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার মিছিলে গুলি ছোড়া হয়; নিহত হন অন্তত ছয়জন। সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ঘটনার ছবি-ভিডিও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলনকে দেশব্যাপী স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে উত্তপ্ত করে তোলে, যার ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং ৮ আগস্ট অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
• শহীদের সংখ্যা (সরকারি তালিকায়) : ৬৭৮ জন, যার মধ্যে ১৬ জুলাই নিহত ৬ জনকে ‘জুলাই শহীদ’ বলা হয়।
• আহত ও ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে নিবন্ধিত : ৩,৪২০ জন।
• প্রতি শহীদ পরিবারকে এককালীন অনুদান : ৩০ লাখ টাকা; মাসিক ভাতা ৫০ হাজার টাকা।
• প্রস্তাবিত ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ বাজেট : ১১১ কোটি টাকা; স্থান – সাবেক গণভবন।
প্রতিক্রিয়া
রংপুরের বাবনপুর গ্রামে আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করতে হাজারো মানুষ ভিড় করেন। তাঁর বাবা মকবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, “দ্রুত বিচার শেষ না হলে আত্মত্যাগ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোমবাতি প্রজ্বালন, কালরাত্রি মিছিল ও তথ্যচিত্র প্রদর্শনে অংশ নেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সামাজিক মাধ্যমে #JulyMartyrs ও #নতুনবাংলাদেশ হ্যাশট্যাগে তরুণদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর যৌথ বিবৃতিতে “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতা” বজায় রাখার দাবি এসেছে।
বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই জানান, স্বাধীনতার পর ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চের বাইরে এটিই প্রথম গণভিত্তিক দিবস, যেটি সরাসরি তরুণদের আন্দোলন থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তানজীমউদ্দিন খান মনে করেন, “এই স্বীকৃতি তরুণ ভোটারদের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়ক।” তবে প্রথম আলো ও জনকণ্ঠে প্রকাশিত মতামতে সতর্ক করা হয়েছে—মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কোনো দিবসই ইতিহাস-রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা সম্ভব হয়নি; তাই ‘জুলাই চেতনা’কে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করতে হবে।
এরপর কী
সরকার ঘোষণা করেছে—
১. আগামী তিন মাসের মধ্যে ‘জুলাই শহীদ পূর্ণাঙ্গ তালিকা’ গেজেট আকারে প্রকাশ।
২. ৫ আগস্টের আগেই সাবেক গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে’ রূপান্তর; কাজ চলছে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে।
৩. প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই চত্বর’ ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির নির্দেশ।
৪. আহত আন্দোলনকারীদের পুনর্বাসনে স্বল্পসুদে ঋণ ও চিকিৎসা সহায়তা তহবিল।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানালেও আইন মন্ত্রণালয় বলছে, বিদ্যমান আদালতের মাধ্যমেই বিচার এগোবে।