চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর ‘টপ আর্নার’ মধুমতি, ১২ বছরে কীভাবে গড়ল দৃষ্টান্ত

চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর ‘টপ আর্নার’ মধুমতি, ১২ বছরে কীভাবে গড়ল দৃষ্টান্ত

ঢাকার বেসরকারি খাতের মধুমতি ব্যাংক ২০১৩ সালে চালু হওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংকের একটি। প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পার করে ব্যাংকটি এখন একই প্রজন্মের মধ্যে সর্বোচ্চ নিট মুনাফা (১২৬ কোটি টাকা, ২০২৩) এবং সর্বনিম্ন খেলাপি ঋণ অনুপাত (২.৩০%) ধরে রেখেছে। ব্যাংকটির সদর দফতর ঢাকায়; দেশের ৫২টি শাখা, ৪৭টি এটিএম ও ৬৪৩টি এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। ৮ হাজার ১১ কোটি টাকার আমানত ও ৬ ৬৩ কোটি টাকার ঋণ পোর্টফোলিও নিয়ে তারা গত বছর ৪ ৭৯৫ কোটি টাকার আমদানি এবং ৫ ৩৭০ কোটি টাকার রপ্তানি বিল পরিচালনা করেছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দক্ষ মানবসম্পদ, ‘বেছে নেওয়া’ করপোরেট গ্রাহক এবং কম খরচের তহবিলই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকায় সমালোচনা ছিল। তবু নিয়ম-নীতি মেনে পরিচালনা, নিয়ন্ত্রক সূচক মেনে চলা ও ধারাবাহিক প্রযুক্তি বিনিয়োগ তাদের দ্রুতই আলাদাভাবে চিনিয়েছে। এখন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় বিনিয়োগকারীরাও নজর রাখছেন।

পটভূমি

২০০৯–১৩ মেয়াদে অর্থনীতির ‘অর্থায়ন ঘাটতি’ মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়; এগুলোকে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক বলা হয়। মধুমতি ব্যাংক ওই তালিকায় তৃতীয়। উদ্যোক্তা হিসেবে মেঘনা, লাবিব ও শারমিন গ্রুপের সঙ্গে কয়েকজন সাবেক সাংসদ থাকায় শুরুতে পেশাদারিত্ব ধরে রাখবে কি না—এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। ব্যাংকটি শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্পোরেট গভর্ন্যান্স নির্দেশনা কঠোরভাবে মানে এবং ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি প্রোগ্রামের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ করে, ফলে ‘রাজনীতির ছায়া’ তেমন পড়েনি।

সংখ্যায় তথ্য

• আমানত: ৮,০১১ কোটি টাকা (২০২৩)

• ঋণ: ৬,৬৩৩ কোটি টাকা

• খেলাপি ঋণ: ১৫৩ কোটি টাকা (মাত্র ২.৩০%)

• নিট মুনাফা: ১২৬ কোটি টাকা

• মূলধন পর্যাপ্ততা: ১৫.৮০% (নিয়মিত চাহিদার চেয়েও বেশি)

• খরচ-আয় অনুপাত: প্রতি ১০০ টাকায় ব্যয় ৩৪.৪৬ টাকা

• তহবিলের গড় খরচ: ৬.৩১%

• করপোরেট/খুচরা ঋণ অনুপাত: ৭৮% বনাম ২২%

• শাখা: ৫২ (২০২4 সালে লক্ষ্যমাত্রা ৬০)

• কর্মী: ৭৬০ জন

বিশ্লেষণ

ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণ যেখানে ১০% ছুঁই–ছুঁই, সেখানে মধুমতির অনুপাত ২%-এর ঘরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বীমা বিভাগের অধ্যাপক আবু ইউসুফ মনে করেন, “তারা অতিরিক্ত মুনাফা নয়, স্থায়ী প্রবৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়েছে—খেলাপি কমার প্রধান কারণ এটাই।” আরও দুটি বিষয় লক্ষণীয়: (১) আমানতের ৫৫% করপোরেট হওয়ায় বড় অঙ্কের স্বল্প-মূল্যের ডিপোজিট পায়; (২) প্রযুক্তি-নির্ভর সেন্ট্রালাইজড ক্রেডিট প্রসেস ‘রিকভারি’ দ্রুত করে। অন্যদিকে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না হলেও উদ্যোক্তাদের ১৩৮% নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে, যা স্বচ্ছতা ও লভ্যতার ইঙ্গিত দেয়। তবে বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা—করপোরেট ঋণের অতিরিক্ত নির্ভরতা ও উচ্চ জমাকাঠামো ব্যাংককে অর্থনৈতিক ধাক্কায় ঝুঁকিতে ফেলতে পারে; তাই ঘোষিত এসএমই ও কৃষি-ঋণ বিস্তারের পরিকল্পনা কার্যকর করা জরুরি।

এরপর কী

ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২5-এর মধ্যে ঢাকা ও বিভাগীয় শহরে ৮টি নতুন শাখা চালু হবে এবং আইপিও মাধ্যমে পুঁজি তুলে মূলধন পর্যাপ্ততা ১৭%-এ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে ডিজিটাল চ্যানেলে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কৃষি-ঋণ দিতে ‘স্মার্ট ফার্মিং লোন’ এবং ‘নগদ এসএমই’ নামে দুটি পণ্য আসছে। বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তালিকাভুক্তি হলে ব্যাংকের স্বচ্ছতা আরও বাড়বে, তবে পুঁজিবাজারে শক্তিশালী পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পরিচালন ব্যয় আরও কমানো ও খেলাপি ঋণ ২%-এর নিচে নামিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

More From Author

কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে সহিংস শাটডাউন: জুলাইয়ের ঢাকার অস্থির পাঁচ দিন

চট্টগ্রামের বিক্ষোভে গুলি, মেঘনায় জলদস্যু গ্রেপ্তার, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক খুন: বেড়ে চলা আগ্নেয়াস্ত্রের ছোবল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *