গোপালগঞ্জে এনসিপি সমাবেশে হামলা, নিহত ৩: নিরাপত্তা ব্যর্থতার প্রশ্নে তীব্র বিতর্ক
বুধবার (১৬ জুলাই) গোপালগঞ্জ জেলা শহরের পৌর পার্কে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এর (এনসিপি) পূর্বঘোষিত সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সমর্থকরা দু’দফা হামলা চালায়। প্রথম আলো ও বাংলা ট্রিবিউনের তথ্য অনুযায়ী, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সংঘর্ষে অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও policসহ ২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। হামলাকারীরা পুলিশ ও ইউএনও-র গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়, কারাগারের গেট ভাঙার চেষ্টা করে এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও অতিরিক্ত পুলিশ এসে এনসিপি নেতাকর্মীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়। ঘটনাটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতি ও পক্ষপাত নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন তুলেছে, আর রাজনৈতিক দলগুলো একে ‘‘ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান’’ ও ‘‘গণতন্ত্রবিরোধী বর্বরতা’’ বলে নিন্দা করছে।
পটভূমি
গত বছরের শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনের পর বিএনপি, জামায়াত ও ১২-দলীয় জোটের বাইরে বিকল্প শক্তি হিসেবে উঠে আসে এনসিপি। দলটি ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘোষণা করে শেখ হাসিনার জন্মজেলায় ‘‘সমমর্যাদা ও বৈষম্যবিরোধী চার্টার’’ প্রচারের লক্ষ্যে জনসভা করে আসছিল। সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলও পরোক্ষে এই কর্মসূচিকে সমর্থন দিচ্ছিল। তবে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে চলতি বছরে ‘দেশব্যাপী সহিংস তৎপরতার’ দায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি নির্দেশনায় সাময়িকভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছিল, যেটি মাঠপর্যায়ে মানা হয়নি।
ঘটনাপ্রবাহ
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সকাল ৯টা ৩০-এ সদর উপজেলার খাটিয়াগড়ে পুলিশ ভ্যানে ইটপাটকেল ছোড়া হয় এবং পরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ইউএনও এম রাকিবুল হাসানের গাড়িতে হামলার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। দুপুর ১টা ৪৫-এ পৌর পার্কের মঞ্চে প্রথম দফা হামলায় সাউন্ড সিস্টেম ও আসবাব ভাঙচুর করা হয়। সমাবেশ সমাপ্তির পর ফেরার পথে এনসিপির গাড়িবহর ঘিরে দ্বিতীয় দফা হামলা হলে গুলি ছোড়ে উভয় পক্ষ; এতে তিনজন মারা যায় ও অন্তত ১৭ জন আহত হন। বিকেলে জেলা কারাগারের গেট লক্ষ্য করে ইট ছোড়া ও একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরানোর ঘটনাও ঘটে।
প্রতিক্রিয়া
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রথম আলোকে পাঠানো বিবৃতিতে বলেন, ‘‘গোপালগঞ্জ বাংলাদেশেরই অংশ; এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা উদ্বেগজনক।’’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এমটিনিউজ২৪-এ বলেন, ‘‘দুষ্কৃতকারীদের কঠোর হস্তে দমনের বিকল্প নেই।’" খেলাফত মজলিস ‘গণতন্ত্রবিরোধী বর্বরতা’ আখ্যা দিয়ে দোষীদের গ্রেপ্তার দাবি করেছে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার বিবৃতি দিয়ে ‘‘কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’’ বলে আশ্বাস দিয়েছে এবং সেনা-পুলিশের দ্রুত হস্তক্ষেপের প্রশংসা করেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেননি, তবে স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত বছরের ক্ষমতা পরিবর্তনের পর দেশের নিরাপত্তা কাঠামো ‘স্বপ্নের মতো স্থিতিশীল’ ছিল—গোপালগঞ্জের ঘটনা সেই ধারণায় বড় ধাক্কা দিল। সুশাসন ফোরামের গবেষক তানভীর সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ না হলে মাঠের শক্তি প্রদর্শনের প্রবণতা বাড়বে, যা আগামী পৌর নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা বাড়াতে পারে।’’ ২৪ ঘণ্টায় দেশজুড়ে পুলিশের বিশেষ অভিযানে ১,৬৬৫ জন গ্রেপ্তার (পুলিশ সদর দপ্তর) দেখিয়ে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হচ্ছে বলে দাবি করলেও গোপালগঞ্জে তা কার্যকর হয়নি—এ প্রশ্ন এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে।
এরপর কী
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, হামলাকারীদের শনাক্তে সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে; অস্ত্র আইনে পৃথক মামলা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন চাইছেন। এদিকে, এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মাদারীপুর পদযাত্রা স্থগিত করা হলেও সমর্থকেরা সেখানে জড়ো হয়ে রয়েছে; শহরের প্রবেশদ্বারে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন। পর্যবেক্ষকদের মতে, দ্রুত বিচার না হলে দেশের অন্য জেলায় ‘‘কপিক্যাট’’ হামলা বা পাল্টা মিছিল-সমাবেশের ঝুঁকি বাড়বে, যা ইতিমধ্যেই চাপের মুখে থাকা অর্থনীতি ও স্বাভাবিক জনজীবনে নতুন অনিশ্চয়তা যোগ করতে পারে।