গোপালগঞ্জে এনসিপি সমাবেশে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, কারফিউ ও দেশজুড়ে প্রতিবাদ

গোপালগঞ্জে এনসিপি সমাবেশে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, কারফিউ ও দেশজুড়ে প্রতিবাদ

বুধবার ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্কে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত মাসব্যাপী ‘জুলাই পদযাত্রা’ সমাবেশে হামলা ও পাল্টা সংঘর্ষে কমপক্ষে চার জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। এনসিপি ও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, সংঘর্ষ শুরু হয় দুপুর দেড়টার দিকে যখন নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সমর্থকেরা মঞ্চ ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-সেনা টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। সন্ধ্যা ৮টা থেকে পরদিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জেলায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। একই দিনে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে এনসিপি ও সহমত ছাত্র সংগঠনগুলো সংক্ষিপ্ত অবরোধ করে প্রতিবাদ জানায়, যা পরে প্রত্যাহার করা হয়।

প্রেক্ষাপট

গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এনসিপি সারা দেশে পদযাত্রা ও সমাবেশ করছে। প্রাক্তন শাসক আওয়ামী লীগের জন্মজেলায় অনুষ্ঠান করাকে কেন্দ্র করে দুই দিন ধরেই উত্তেজনা দানা বাঁধে। সকালে পুলিশের গাড়িতে আগুন এবং ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুরের পর থেকেই শহর সরগরম ছিল। বেলা দুইটার মধ্যে ২০০-৩০০ লাঠিসোঁটা-ধারী লোক সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। এনসিপি নেতাদের গাড়িবহর ফেরার পথে কলেজ গেট এলাকায় ফের হামলা হয়, র‍্যাব ও সেনাবাহিনী মাঠে নামে। বাজার, হাসপাতাল, জেলখানার সামনে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।

গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা

• নিহত: ৪ (ঢাকা টাইমস, বিবিসি বাংলা ও গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল সূত্র)

• আহত: ১০০-এর বেশি, এর মধ্যে অন্তত ৯ জন গুলিবিদ্ধ

• কারফিউ: ২২ ঘণ্টা (১৬ জুলাই রাত ৮টা–১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা)

• অবরোধ স্থায়ী: পদ্মা সেতু ৩০-৫০ মিনিট, ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক ৩০ মিনিট, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ১ ঘণ্টা

• এনসিপি নেতাদের বহর: ১৫-১৬টি গাড়ি, সেনা সাঁজোয়া যান পাহারা

প্রতিক্রিয়া

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘটনাকে ‘মুজিববাদীদের বর্বরতা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না হলে ‘কঠোর কর্মসূচি’ ঘোষণা করবেন বলে সতর্ক করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রথমে দেশব্যাপী ‘ব্লকেড’ ডাক দিলেও সন্ধ্যার দিকে ব্লকেড তুলে রাস্তার পাশে অবস্থানের নির্দেশ দেয়।

পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “লিথ্যাল অস্ত্র ব্যবহার করিনি, ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি; অতিরিক্ত ফোর্স পাঠানো হয়েছে।” অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেস উইং এক বিবৃতিতে হামলাকে “ঘৃণ্য ও বর্বর” উল্লেখ করে দ্রুত দোষীদের বিচারের আশ্বাস দিয়েছে।

বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও জাগপা পৃথক বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দা ও দোষীদের শাস্তি দাবি করেছে।

এরপর কী

জেলা প্রশাসনের ১৪৪ ধারা ও কারফিউ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শেষ হওয়ার কথা, তবে পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে সময় বাড়তে পারে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, যৌথ তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। হাসপাতাল সূত্রে নিহতদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলে মামলা দায়ের হবে। এনসিপি আগামী শুক্রবার ঢাকায় ‘প্রতিবাদ সমাবেশ’ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিশ্লেষণ

গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যগত জমিন; সেখানে সরকার-বিরোধী কোনো জমায়েত রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। পর্যবেক্ষকদের মতে, ‘জুলাই আন্দোলন’ দেশের বিরাজমান ক্ষমতা কাঠামোকে খোঁচা দিচ্ছে। সংঘর্ষ, কারফিউ ও মহাসড়ক অবরোধ – তিনটি স্তরে যে উত্তেজনা দেখা গেল, তা আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজপথে শক্তিপরীক্ষার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অপ্রাণঘাতী’ কৌশল হতাহতের সংখ্যা কমালেও রাজনৈতিক সমাধান অনিশ্চিত থাকলে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা কঠিন হবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

শেষ কথা

এক দিনের সহিংসতা গোপালগঞ্জকে অচল করেছে, ঢাকার রাজপথও উত্তপ্ত হয়েছে। নিহতদের দাফন, তদন্ত ও রাজনীতি—সব কিছুর দ্রুত, স্বচ্ছ সমাধান না হলে ছোট শহরের সংঘর্ষ যে কত দ্রুত জাতীয় সংকটে রূপ নিতে পারে, আজকের ঘটনা তারই সতর্ক বার্তা।

More From Author

আইসিসির নতুন র‍্যাঙ্কিংয়ে নজর কাড়লেন রিশাদ, জেল্লা বাড়াল বাংলাদেশের দল

কক্সবাজারে ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা ঘিরে বিএনপি-জামায়াত টানাপোড়েন বাড়ছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *