কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে সহিংস শাটডাউন: জুলাইয়ের ঢাকার অস্থির পাঁচ দিন

কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে সহিংস শাটডাউন: জুলাইয়ের ঢাকার অস্থির পাঁচ দিন

সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে ১৫ জুলাই ২০২৪ থেকে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ১৫-১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও আশপাশের সড়কে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, পুলিশের পাল্টা ধাওয়া ও লুটপাটের ঘটনায় শহর প্রায় অচল হয়ে পড়ে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুর পর ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ডাক দিলে সহিংসতা আরও ছড়িয়ে যায়; দিনের শেষে মেট্রো রেলের চলাচল বন্ধ হয়, ইন্টারনেট সেবা ব্লক করা হয়। ১৯ জুলাই গভীর রাতে সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। বাংলা ট্রিবিউনের তথ্য অনুযায়ী মিরপুরের দু’টি হাসপাতালে অন্তত ১৪ জনের মরদেহ এবং শতাধিক আহতকে ভর্তি করা হয়। অভূতপূর্ব এই দাঙ্গা ঢাকাবাসীর কাছে ‘অচেনা ঢাকা’ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

কিভাবে এই পর্যন্ত এলাম

কোটা সংস্কার দাবিতে ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ১৫ জুলাই বিক্ষোভ শুরু করেন। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের হামলা পরিস্থিতি ঘোলাটে করে। ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন শহরে ছাত্র–শিক্ষক-অভিভাবকদের প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে; রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্র আবু সাঈদ, যা আন্দোলনে আগুন লাগায়। সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেও ক্যাম্পাস না ছাড়ার কৌশল নেয়া হয়। ১৭ জুলাই রাতে ঘোষণা আসে ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’, সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইল ডাটা বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৮ জুলাই সকাল থেকেই মিরপুর ১০ নম্বর, কাজীপাড়া, ফার্মগেটে সংঘর্ষ, আগুন, ভাঙচুর শুরু হয়। ১৯ জুলাই বিকেলে সহিংসতা চরমে পৌঁছালে রাত ১২টা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়।

গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা

• ৫ দিন: ১৫-১৯ জুলাইয়ের অচলাবস্থা

• ১ জন: ১৬ জুলাই রংপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রথম মৃত্যু

• অন্তত ১৪ জন: ১৯ জুলাই রাত পর্যন্ত মিরপুরের দুটি হাসপাতালে নেয়া মৃতদেহ (Bangla Tribune)

• ১০০+ : আহত ছাত্র-শিক্ষার্থী ও পথচারী, হাসপাতাল সূত্র

• ২৯টি: উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য কনটেইনার পুড়েছে

• ১৪টি: সরকারি-বেসরকারি যানবাহন ভাঙচুর

• ২ দিন: মোবাইল ডাটা ও পরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্লকড

• ১মিনিটও চলেনি মেট্রোরেল: ১৮ জুলাই দুপুরে ট্র্যাক অবরোধে বন্ধ হয়ে যায়

প্রতিক্রিয়া

সরকার আন্দোলন ‘অপশক্তির উসকানি’ বলে আখ্যায়িত করে দ্রুত কঠোর অবস্থান নেয়; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রয়োজনে আরও শক্তি প্রয়োগ করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা’। বিপরীতে ঢাকা ও মিরপুরের বাসিন্দারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তারা খাবার, পানি, এমনকি সংবাদপত্র ছুড়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের সমর্থন করেছেন। চিকিৎসক মুসফিক উস সালেহীন বলেন, হাসপাতাল সেবা অব্যাহত রাখায় পুলিশি হুমকিও এসেছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার দাবি করেছে—সহিংসতার স্বাধীন তদন্ত দরকার, বিশেষ করে পুলিশের গুলি ও গ্রেনেড ব্যবহারের বিষয়টি। ব্যবসায়ী সমিতি এমসিসিআই ক্ষয়ক্ষতি প্রাথমিকভাবে ৫০০ কোটি টাকা হিসেবে উল্লেখ করেছে।

এরপর কী

কারফিউ শিথিল হলেও রাজধানীতে রাত ১০টার পর গণজমায়েত নিষিদ্ধ রয়েছে, এবং আদালতের নির্দেশ ছাড়া বড় সমাবেশ অনুমোদন করা হচ্ছে না। কোটা সংস্কার নিয়ে নতুন ‘জাতীয় কমিটি’ গঠন করতে শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে, তবে অধিকার গোষ্ঠীগুলো পুলিশের বিপক্ষে স্বাধীন বিচারিক অনুসন্ধান চাইছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা আরও বাড়তে পারে। বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিচ্ছেন—স্বচ্ছ সংলাপ ও পূর্ণ ইন্টারনেট খুলে দেওয়াই উত্তেজনা প্রশমন এবং ক্ষতির আস্থাবর্তনে জরুরি।

More From Author

বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ায় মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালু

চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর ‘টপ আর্নার’ মধুমতি, ১২ বছরে কীভাবে গড়ল দৃষ্টান্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *